প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা প্রস্তুতি, ভাইভা পরীক্ষার ভেতর বাহির ও ভাইভার সময় পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে লিখেছেন গাজী মিজানুর রহমান।
ভাইভা পরীক্ষার মানবণ্টন
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় মোট ১০০ নম্বর থাকে। এর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় (এমসিকিউ টাইপের) ৮০ নম্বর থাকে এবং বাকি ২০ নম্বর থাকে ভাইভা বোর্ডের হাতে। আগে ভাইভা বোর্ডের ২০ নম্বরের মধ্যে ৫ নম্বর থাকত এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রি/ অনার্স (ক্ষেত্রবিশেষে) পরীক্ষায় প্রাপ্ত রেজাল্টের ওপর। বাকি ১৫ নম্বর থাকত ভাইভা বোর্ডে প্রার্থীর পারফরম্যান্সের ওপর।
কিন্তু গত ১৯ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষার নম্বর বণ্টন প্রকাশ করা হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ২০ নম্বরের বিভাজনসংক্রান্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল জারি করা পত্রে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বণ্টন সংশোধন করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দীন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বিভাজনের বিষয়ে বলা হয়েছে, মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ২০ নম্বর থাকবে।
আর এই ২০ নম্বরের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতায় ১০ নম্বর এবং ব্যক্তিত্ব, প্রকাশ ক্ষমতা, সাধারণ জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ১০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে; অর্থাৎ এখন থেকে এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রি/অনার্স (ক্ষেত্রবিশেষে) পরীক্ষায় প্রাপ্ত রেজাল্টের ওপর ১০ নম্বর থাকবে। বাকি ১০ নম্বর থাকবে প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, প্রকাশ ক্ষমতা, সাধারণ জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর। মৌখিক পরীক্ষার নতুন নম্বর বণ্টনের শিক্ষাগত যোগ্যতায় যে ১০ নম্বর রাখা হয়েছে, এর মধ্যে এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের ক্ষেত্রে ৪, এইচএসসি ও সমমানে ৪ এবং স্নাতক ও সমমানের ফলাফলের ক্ষেত্রে ২ নম্বর বরাদ্দ। কোনো প্রার্থীর এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমানে প্রথম বিভাগ বা জিপিএ-৩.০০ বা এর বেশি থাকলে ৪ নম্বর পাবেন। দ্বিতীয় বিভাগ/জিপিএ-২.০০ থেকে ৩.০০-এর কম হলে ৩ নম্বর পাবেন। তৃতীয় বিভাগ/জিপিএ-১.০০ থেকে ২.০০-এর কম হলে ১ নম্বর পাবেন।
প্রার্থীর স্নাতক বা সমমানের ক্ষেত্রে প্রথম বিভাগ/সমতুল্য সিজিপিএ-৪-এর স্কেলে ৩.০০ বা এর বেশি, সিজিপিএ-৫-এর স্কেলে ৩.৭৫ বা এর বেশি হলে ২ নম্বর পাবেন। দ্বিতীয় বিভাগ বা সমতুল্য সিজিপিএ-৪-এর স্কেলে ২.২৫ থেকে ৩.০০-এর কম, সিজিপিএ-৫-এর স্কেলে ২.৮ থেকে ৩.৭৫-এর কম হলে ১ নম্বর পাবেন।
ভাইভা পরীক্ষার ভেতর বাহির
অল্প সময়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য যেমন পড়াশোনা করা প্রয়োজন, তেমনি অন্যান্য প্রস্তুতিও নিতে হবে। ভাইভা পরীক্ষার আগের দিন, ভাইভার দিন ও ভাইভা বোর্ডের ভেতরের করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আগের দিনের প্রস্তুতি
- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী বোর্ডের সামনে প্রবেশপত্র, শিক্ষাজীবনের সব সার্টিফিকেটের মূল কপিসহ যেসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে হবে, সেগুলো আগের রাতেই গুছিয়ে একটি ভাইভা ফাইলে রেখে দিন।
- ভাইভা ফাইলে অবশ্যই কমপক্ষে দুইটি চলিত কলম (একদম নতুন কলম নয়) রাখবেন।
- ভাইভার দিন যে পোশাক পরবেন, সেটা আগেই ঠিক করে গুছিয়ে রাখুন।
- ভাইভার দুই-তিন দিন আগে ছেলেরা মাথার চুল সুন্দর ও মার্জিতভাবে কাটিয়ে নিন।
- ভাইভার আগের রাতে পর্যাপ্ত ঘুমালে ভাইভা বোর্ডে মাথা কাজ করে বেশি। না হয় অনেক সময় পারা প্রশ্নে উত্তর মাথায় আসে না। তাই ভাইভার আগের রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন এবং টেনশনমুক্ত ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করুন।
- ভাইভার প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ বা অপর্যাপ্ত মনে করে বাড়তি টেনশন করবেন না।
ভাইভার দিনের প্রস্তুতি
- ছেলে প্রার্থীরা আগের দিন শেভ না করে থাকলে শেভ করে নিন।
- ভাইভা বোর্ডে যেন নির্ধারিত সময়ের এক-দুই ঘণ্টা আগে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়, সেভাবে হাতে সময় নিয়ে বের হোন বাসা থেকে। ভাইভা বোর্ডে আগে উপস্থিত হতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়। হাতে কম সময় নিয়ে বের হলে, ভাইভা বোর্ডে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারা না পারার টেনশনে অনেক কিছু ভুলে যেতে পারেন।
- ভাইভা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভাইভা বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বা অফিস সহকারীর কাছে পরবর্তী করণীয় বিষয় জেনে নিন।
- ভাইভা বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বা অফিস সহকারীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী কাজগুলো ফেলে না রেখে যতটা সম্ভব সঙ্গে সঙ্গে করার চেষ্টা করুন ঝামেলামুক্ত থাকার জন্য।
- ভাইভা বোর্ডে আপনার সিরিয়াল পরে থাকলে, যাঁদের ভাইভা আপনার আগে হয়ে যাবে, তাঁদের কাছ থেকে ভাইভার প্রশ্নের ধারণা নিতে পারেন কিছুটা। তবে সেসব প্রশ্ন নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না; কেবল ধারণা নেবেন প্রশ্নের প্যাটার্ন বোঝার জন্য। আপনার আগের প্রার্থীকে যে প্রশ্নটি করেছে, ঠিক একই প্রশ্ন আপনাকেও যে করবে, এমন সম্ভাবনা একদম কম।
ভাইভা বোর্ডের ভেতরের করণীয়
- বোর্ড থেকে যতক্ষণ না ভেতরে যাওয়ার কথা বলে, ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করুন।
- ভেতরে যাওয়ার জন্য ডাকলে বা বেল বাজলে সালাম দিয়ে অনুমতি নিয়ে বোর্ডের ভেতরে প্রবেশ করুন এবং আগ থেকেই নিজের পকেটে বা হাতে একটি কলম রাখুন। ভাইভা বোর্ডের ভেতরে কলমের কাজ থাকতে পারে।
- ভেতরে ঢোকার পর বসার অনুমতি দিলে বসবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ দেবেন।
- ভেতরে বসার অনুমতি না দিলে, ‘স্যার, আমি কি বসতে পারি?’-এভাবে অনুমতি নিয়ে বসবেন। বসতে বললে বসবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ দেবেন।
- ভাইভা বোর্ডে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব অল্প কথায় এবং টু দ্য পয়েন্টে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন এবং অতিরিক্ত কথা পরিহার করার চেষ্টা করুন।
- যিনি প্রশ্ন করবেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে হাসিমুখে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন।
- জানা না থাকলে হাসিমুখে ‘দুঃখিত স্যার, আপার এই প্রশ্নের উত্তরটি জানা নেই’ অথবা ‘স্যরি স্যার, এ মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না’ বলে দেবেন। একেবারে জানা না থাকলে, আন্দাজে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। না হয়, বোর্ড আপনাকে নেগেটিভলি নিতে পারে।
- প্রশ্নে উত্তর করার সময় হাত-পা নাড়াবেন না এবং মুদ্রাদোষ ও আঞ্চলিকতা পরিহার করুন যথাসম্ভব।
- ভাইভা বোর্ডের কারও সঙ্গে তর্কে জড়াবেন না কিংবা বেয়াদবি করবেন না।
- কবিতা আবৃত্তি/নাচ/গান/অভিনয়—এসব বিষয়ে আপনার দক্ষতা না থাকলে বিনয়ের সঙ্গে বলুন, ‘আমি খুব ভালো পারি না। তবে আপনারা অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।’ এ ক্ষেত্রে একদম সরাসরি না বলাটা সমীচীন হবে না। আপনার এ বিষয়ে দক্ষতা না থাকলে এখনই প্র্যাকটিস করুন। প্রয়োজনে ইউটিউবের সাহায্য নিতে পারেন।
- আপনাকে ভাইভা কক্ষ ত্যাগ করার কথা বললে, প্রথমে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াবেন; তারপর সালাম দিয়ে স্বাভাবিকভাবে নিঃশব্দে ভাইভা কক্ষ ত্যাগ করবেন।
ভাইভার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ
ভাইভার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ড্রেস নেই। যেকোনো মার্জিত ও রুচিশীল পোশাক পরা যায়। তারপরও এখানে ভাইভার পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো:
ছেলেদের পোশাক-পরিচ্ছদ
কোনো মার্জিত কালারের ফুলহাতা শার্ট পরবেন। তবে সাদা বা অন্য কোনো মার্জিত এক কালারের শার্টও পরা যেতে পারে। এক কালারের শার্টের ওপর কোনো মার্জিত স্ট্রাইপ থাকলেও সমস্যা নেই। ফুলহাতা শার্টের সঙ্গে কালো রঙের বা অন্য কোনো ফরমাল কালারের ফরমাল প্যান্ট পরবেন। তবে গরমকালে শার্টের সঙ্গে টাই-কোট পরবেন না। কারণ গরমের সময় টাই-কোট না পরার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। হাতে মার্জিত কোনো হাতঘড়ি পরলে বেশ সুন্দর দেখা যাবে। সু ও বেল্ট চামড়ার ফরমালগুলো পরবেন। সুর সঙ্গে অবশ্যই মোজা পরবেন।
উল্লেখ্য, কেউ চাইলে ভাইভা বোর্ডে ফরমাল কালারের পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। মুখে দাঁড়ি থাকলেও সমস্যা নেই। মূল কথা হলো, মার্জিতভাবে পরিপাটি হয়ে ভাইভা বোর্ডে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে।
মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ
মার্জিত রঙের শাড়ি পরিধান করতে পারেন। কেউ চাইলে সালোয়ার-কামিজও পরতে পারেন। তবে তা যেন মার্জিত, রুচিসম্মত রং ও ডিজাইনের হয়। পায়ের জুতা
শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে মিলিয়ে পারতে পারলে বেশি ভালো হয়। তবে হাই হিলের জুতা পরে ভাইভা বোর্ডে না যাওয়াই ভালো। স্বাভাবিক কানের দুল এবং গলায় চেইন পরতে পারেন। চাইলে সঙ্গে হালকা মেকআপ এবং মার্জিত রঙের হালকা লিপস্টিকও ব্যবহার করতে পারেন।
উল্লেখ্য, কেউ চাইলে বোরকা ও হিজাব পরে যেতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই (অধিকন্তু, সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট বোরকা বা হিজাব পরাকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন)। তবে বোরকা বা হিজাব পরলেও মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখতে হবে।
সূত্র: আজকের পত্রিকা