নারী ও পুরুষ সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও যুগের পর যুগ সমাজে নারীরা নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ উপার্জন, সিদ্ধান্তগ্রহণ—প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর জন্য এ এক কঠিন বাস্তবতা। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সামাজিক কুসংস্কার মূলত এর জন্য দায়ী।
সমাজে বিদ্যমান এই বৈষম্যকে শনাক্ত করা এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে করণীয় ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক আড্ডায় উঠে এলো শিক্ষার্থীদের নানা পর্যবেক্ষণ।
‘ছোটবেলা থেকেই বৈষম্যের শিকার আমি। এই বৈষম্যের গোড়াপত্তন আমার পরিবারেই। অনেক সংগ্রাম করে এত দূর এসেছি। এ বিভাগটি যেন আমার কথাই বলে’, তৃতীয় বর্ষের মাহিরাতুল জান্নাত এভাবেই ব্যক্ত করছিলেন তাঁর কথা। ‘নারীকে দমন করে পুরুষের ক্ষমতায়ন চলার ফলেই আজও সভ্যতাকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষিত সমাজ তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উন্নত হয়নি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী। এখনো সেকেলেই রয়ে গেছে নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টি’, বলছিলেন চতুর্থ বর্ষের শরীফা সুলতানা।
‘এ বিভাগে পড়তে আসার পরই নারী-বৈষম্যের দিকগুলো স্পষ্ট করে ধরা পড়ে আমার চোখে। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী নয়, এ বিভাগ আমাকে গড়ে তুলছে সচেতন নাগরিক হিসেবেও’, কথাগুলো চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আলী আহসানের।
প্রধানত কী কী বিষয় নিয়ে পড়তে হয় এখানে জানতে চাইলে শরীফা সুলতানা বলেন, ‘জেন্ডার স্টাডিজ এখন পরিণত হয়েছে সমস্যা সমাধানের হাতিয়ারে। অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ উন্নয়নের প্রতিটি খাতে নারী কীভাবে অবদান রাখছে বা সমাজের সব অবস্থানে নারীকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে অধ্যয়ন করি আমরা।’
সমাজের সার্বিক পরিস্থিতিতে আসলেই কি নারীদের উন্নতি হয়েছে? হলে তা কত দূর? ‘আমরা সেটাই গবেষণা করি। যেমন মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে কি না, এ তথ্য যাচাই করার জন্য ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে জরিপ চালিয়েছি এবং দেখেছি আসলেই এ হার হ্রাস পেয়েছে। এভাবে আমরা নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের সব সম্ভাব্য পন্থা নিয়ে চিন্তা করি এবং তা সমাধানে কাজ করি।’ তৃতীয় বর্ষের ফারিহা জাহানের এই কথায় ঐকমত্য পোষণ করলেন সবাই।
চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী রওশন ই ফাতিমা মনে করিয়ে দেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিক, কিন্তু উচ্চশিক্ষায় নারীদের সংখ্যা এখনো অর্ধেকের অনেক নিচে। জেন্ডার স্টাডিজ মানেই যে শুধু নারী ক্ষমতায়ন তা কিন্তু নয়, ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক গড়নের পরিবর্তনের পাশাপাশি পুরুষদের মানসিক কাঠামোর উন্নয়ন নিয়েও আমরা কাজ করি।’
এ বিভাগে অধ্যয়নের পর কাজের সুযোগ কোথায় জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষা ক্ষেত্র, সবখানেই মিলবে কাজের অফুরন্ত সুযোগ। আর দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ তো রয়েছেই।
বিভাগীয় প্রধান তানিয়া হক বলেন, ‘বর্তমান যুগে নারী তার শিক্ষা, চাকরি, সন্তান নেওয়ার অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে সোচ্চার, কিন্তু আমরা নাগরিকদের কতটুকু জানাতে পারছি আর সমাজ কতটুকু বাস্তবায়িত করতে পারছে, তার মধ্যে বেশ ঘাটতি থেকে গেছে। এর জন্য চাই সমাজের চেহারা পাল্টে দিতে পারে এমন চেঞ্জ-মেকার।’
প্রতিবছর নারী দিবস এবং রোকেয়া দিবসকে প্রাধান্য দিয়ে এ বিভাগ হাতে নেয় নানা কর্মসূচি। এর মধ্যে রয়েছে সেমিনার, শোভাযাত্রা, গোলটেবিল বৈঠক, বিতর্ক, পথনাটক। নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে স্মরণসভা, বইমেলারও আয়োজন করা হয় এ বিভাগের তরফ থেকে।
সূত্র: প্রথম আলো (স্বপ্ন নিয়ে, ১২/১০/২০১৪)