অধ্যাপক এবিএম খায়রুল ইসলাম
মালয়েশিয়া উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ স্থানীয়, নির্ভরযোগ্য ও উন্নত শিক্ষা সহায়ক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মালয়েশিয়া শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উন্নত দেশ হিসেবে এখন বিবেচিত। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার এবং সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির বিন মুহাম্মদের সুদীর্ঘ শাসনামলে দেশটির শিক্ষা-সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্পায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সার্বিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে যা মুসলিম বিশ্বের জন্যে মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
উচ্চ শিক্ষার সুযোগ
সমগ্র মালয়েশিয়া জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের অনেক দেশের বিপুলসংখ্যক বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মালয়েশিয়ায় আসছেন। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য যাচ্ছেন।
শিক্ষার পরিবেশ
মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয় এমন কোন কিছুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত হয় না। শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত রেফারেন্স বইসহ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সরঞ্জামাদির সফল ব্যবহার, দেশী-বিদেশী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে আধুনিক পাঠদান পদ্ধতি, বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত আবাসিক সুবিধা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং ভেজালমুক্ত উন্নত খাবার ব্যবস্থা ইত্যাদি মালয়েশিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান। চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার সর্বস্তরে রয়েছে আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়।
শিক্ষার বিষয়সমূহ
মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অসংখ্য বিষয়ে পাঠদান চালু আছে। এর মধ্যে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, মেডিসিন, ভেটেরিনারী মেডিসিন, মডার্ন ল্যাংগুয়েজ এন্ড কমিউনিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, চার্টার্ড একাউন্টেন্সি, হেলথ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ফরেস্ট্রি, সোস্যাল সাইন্সেস এর সকল শাখা, ইসলামিক স্টাডিস, পরিবেশ বিজ্ঞান, ডিজাইন এন্ড আর্কিটেকচার ইত্যাদি বিষয়সমূহ গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে অনার্স কোর্সে স্টাডি করতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় কমপক্ষে ৩.০০ পয়েন্টের উপরে নম্বর থাকতে হয়। তবে মালয়েশিয়ায় বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়তে পড়াশুনার ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৫.০০ পয়েন্টের নিচে সাধারণত ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায় না।
৩ বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সসমূহ এসএসসি/সমমান পাস শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে। স্কুল অফ বিজনেস এন্ড ল’ ফ্যাকাল্টিতে ডিপ্লোমা ইন বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, ফ্যাকাল্টি অফ নার্সিং এ ডিপ্লোমা ইন নার্সিং, ফ্যাকাল্টি অফ ফার্মাসিতে ডিপ্লোমা ইন ফার্মাসি, ফ্যাকাল্টি অফ বায়োমেডিসিন এন্ড হেলথ এ ডিপ্লোমা ইন অকিউপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ, ডিপ্লোমা ইন হেলথ কেয়ার, ডিপ্লোমা ইন ফিজিওথেরাপি, ডিপ্লোমা ইন এনভায়রনমেন্টাল হেলথ, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ল্যাবরেটরি টেকনোলোজি, ফ্যাকাল্টি অব থেরাপিউটিক সায়েন্স এ ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ইমাজিং, ডিপ্লোমা ইন অকিউপেশনাল থেরাপি, ডিপ্লোমা ইন প্যারামেডিক সায়েন্স ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
যথাযথভাবে পূরণকৃত আবেদনপত্র, সকল শিক্ষাগত ট্রান্সক্রিপটের (ইংরেজি), স্কুল-কলেজের ছাড়পত্র, টোফেল অথবা আইইএলটিএস টেস্টের মার্কশীট, পাসপোর্টের ফটোকপি, আবেদন ফি প্রদানের প্রমাণপত্র, স্পন্সরশীপ সার্টিফিকেট, স্টুডেন্ট পাস এর ভিসা ফি পরিশোধের মানি রিসিট।
শিক্ষা ব্যয়
মালয়েশিয়ায় একজন বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীর জীবন যাত্রার বাৎসরিক ব্যয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় যথাক্রমে ১,৯৫,০০০ থেকে ২,৩৪,০০০ টাকা।
স্বাস্থ্য বীমা
মালয়েশিয়ায় অধ্যয়ন করতে আসা বিদেশী শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ভ্রমণ বীমা থাকতে হবে। প্রতি সেমিস্টারে বীমা খরচ ৩০ থেকে ৪০ মার্কিন ডলার।
কাজের সুযোগ
মালয়েশিয়ায় একজন বিদেশী শিক্ষার্থী তাদের পূর্ণকালীন শিক্ষা শুরু করার পর কাজের অনুমতির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারেন। একজন শিক্ষার্থী সেমিস্টার পরবর্তী ছুটিতে অথবা এক সপ্তাহের অতিরিক্ত মেয়াদের কোন ছুটিতে সপ্তাহে সর্বোচ্চ বিশ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পেয়ে থাকেন। ক্যাম্পাসে যে উপার্জন করা সম্ভব তা দিয়ে বেতন ও জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। কাজ করতে আগ্রহী একজন শিক্ষার্থীর অবশ্যই স্টুডেন্ট পাস থাকতে হবে।
যেসব ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়
মালয়েশিয়ায় বিদেশী শিক্ষার্থীরা রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, মিনি মার্কেট ও হোটেলগুলোতে কাজ করতে পারেন। এসব কাজ ক্যাম্পাসের বাইরে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। প্রতিবেদক নিজে সরজমিনে প্রায় মাস খানেক সময় মালয়েশিয়ার রাজধানীসহ সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে দেখেছেন যে, বাংলাদেশী অধিকাংশ শিক্ষার্থী কোন না কোন পার্টটাইম জবের সাথে সম্পৃক্ত। তবে যেসব শিক্ষার্থীর অভিভাবক সচ্ছল তারা খণ্ডকালীন চাকরি না করে নিয়মিত পড়াশুনা করলে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারে।
ভিসা আবেদন
মালয়েশিয়ায় উচ্চ শিক্ষার্থে স্টুডেন্ট পাস-এর জন্য ঢাকাস্থ মালয়েশিয়ান দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে। দূতাবাস কর্তৃক নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীকে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। তবে ভিসা ইস্যু করা হবে মালয়েশিয়া থেকে।
ঢাকাস্থ মালয়েশিয়ান হাইকমিশনের ঠিকানা: বাড়ী-১৯, রোড-৬, বারিধারা, ঢাকা-১২১২।
আবেদন প্রক্রিয়া
আগ্রহী বিদেশী শিক্ষার্থীকে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট থেকে তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজগুলোর একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। অতঃপর তাকে জানতে হবে তিনি যে বিভাগে ভর্তি হতে চান নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজগুলোর সে বিভাগে ভর্তির আবেদনের শেষ সময়সীমা কবে নাগাদ বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি অফিস বরাবর ভর্তি তথ্য এবং আবেদন ফর্মের জন্য সরাসরি লিখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজের ওয়েবসাইট থেকেও সরাসরি আবেদন ফর্ম ডাউনলোড করে নেয়া যায়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজে অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া চালু আছে।
ভর্তি অফিস থেকে শিক্ষার্থীকে আবেদনপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংক্রান্ত সব তথ্য জানাবে।
শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্টুডেন্ট পাসের জন্য আবেদন করতে হবে।
শিক্ষার্থীর পক্ষে তার পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইমিগ্রেশন হেডকোয়ার্টার-এর ‘পরিচালক, পাস ও পারমিট বিভাগ’ বরাবর আবেদন করবে।
আবেদনের ১ মাসের ভেতর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করবে।
প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র এবং তথ্যাবলী সংগ্রহের জন্য শিক্ষার্থীকে ৪ থেকে ৬ মাস সময় হাতে রেখে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
আবেদনপত্র প্রক্রিয়াকরণ, স্টুডেন্ট পাস অনুমোদন এবং ভিসা ইস্যু ইত্যাদি সবকিছু মালয়েশিয়া থেকে সম্পন্ন করা হয়।
সতর্কতার জন্য পরামর্শ
বাংলাদেশে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করে। শিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঐসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠান যেন কোনরকম প্রতারণা করতে না পারে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত (টিউশন ফি, সেমিস্টার ফি, ভিসা ফি, বিমান ভাড়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের) টাকা নিতে না পারে। প্রতিষ্ঠানগুলো স্টুডেন্ট কনসালটেন্সির জন্য কিছু প্রসেসিং ফি এবং খরচের টাকা নিতে পারে। তবে তা টিউশন ফি, সেমিস্টার ফি, ভিসা ফি, বিমান ভাড়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের চেয়ে খুব বেশি অতিরিক্ত হবে না।