আনিসুর রহমান এরশাদ : ব্রাজিলের জীবন্ত কিংবদন্তী পাউলো কোয়েলো রচিত আলকেমিস্ট আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত, জীবনদর্শনে পরিপূর্ণ, ভাগ্য অনুসন্ধানের অনবদ্য এক জাদুকরী উপন্যাস। বইটির বক্তব্য নি:সন্দেহে যেকোনো শ্রেণীর পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করবে। ভেতরকে নাড়িয়ে দেবে। উদ্দীপ্ত করবে।
আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জীবনের উপলব্ধি নিয়ে পর্তুগিজ ভাষায় রচিত রূপকধর্মী-দার্শনিক উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৯৩ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া যুগান্তকারী বইটি ৮০টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অনেক দেশে সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বের অনেক সফল ব্যক্তিত্ব, যেমন- বিল ক্লিনটন, জুলিয়া রবার্টস, উইল স্মিথ, ম্যাডোনা প্রমুখ বইটি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যারা বইটি এখনো পড়েননি, পড়ে ফেলুন। ভালো লাগবে, ভালো কিছু শিখতে ও জানতে পারবেন। এমন সুন্দর বইয়ের পেছনে ব্যয় করার মতো কিছুটা সময় অবশ্যই বের করে নিন, আপনি জিতবেন।
আমার পড়া আলকেমিস্টের অনুবাদ গ্রন্থটির প্রকাশক ক্যারিয়ার ইন্টেলিজেন্স। বইটির অনুবাদ বেশ ঝরঝরে-চমৎকার। আলকেমিস্টকে সহজ, সাবলীল ও সহজবোধ্য করে বাংলাভাষী পাঠকের সামনে তুলে ধরতে যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন সাংবাদিক মোহাম্মদ হাসান শরীফ। উপন্যাসটির কাহিনী বিন্যাস ও এর অন্তর্নিহিত বক্তব্যে উৎসাহিত হয়েই ভাষান্তর করেছেন তিনি। ভাষার প্রাঞ্জল্য ও দক্ষতার কারণে অনুদিত গ্রন্থটিতেও আলকেমিস্টের মূল বইয়ের স্বাদ অনেকটাই পাওয়া যাবে। একটি জনপ্রিয় বই অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রান্সলেশনে লস্ট’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তিনি সফলভাবে সেটি অতিক্রম করে গেছেন। এমন একটি আত্মোন্নয়নমূলক বই সব পাঠকেরই পড়া দরকার।
এক. সার্থক জীবনের সন্ধান লাভে
আলকেমিস্ট আপনার জীবনের গতিপথ বদলে দেবে। হতাশা দূর করে আশার আলো দেখাবে, ব্যর্থতা ঠেলে সফলতার লক্ষ্যে পৌছাতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। যাদের স্বপ্ন আছে, যারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে এবং সত্যিই সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে চায় তাদের জন্যই এ বই। এটি আপনাকে সার্থক জীবনের সন্ধান দেবে। কিশোর নায়কের লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় মনোবল, প্রতিজ্ঞা অ্যালকেমিস্টকে মুগ্ধ করে। কিশোরকে পথ দেখিয়ে তিনি পৌঁছে দেন পিরামিডের কাছে। আর অনেক পরিশ্রম আর ঘাত-প্রতিঘাতের বিনিময়ে কিশোর খুঁজে পায় কাঙ্ক্ষিত গুপ্তধন। এ পরিশ্রম আর কষ্ট তাকে গুপ্তধনের চেয়েও অনেক বড় জিনিস উপহার দেয়। তা হলো- জীবনের গুঢ় রহস্য ও মহাবিশ্বের ভাষা বোঝার ক্ষমতা। যে ভাষায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত। যা বুঝলে সৃষ্টি বুঝে যায় তার স্রষ্টার উদ্দেশ্য। প্রত্যেক স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসটিকে আধ্যাত্মিক বলে মনে হলেও মানুষের বাস্তব জীবনকে আরো সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলায় এর বিভিন্ন বাণী বা উক্তি প্রয়োগযোগ্য।
দুই. সাফল্যের আসল রহস্য জানতে
আলকেমিস্ট পড়লে সাফল্যের আসল রহস্য জানা যায়। স্বপ্ন আসলেই স্বপ্ন কি-না, ভাগ্যপূরণ আদৌ সম্ভব কি-না, কিভাবে স্বপ্ন পূরণ করা যায়, কিভাবে স্বপ্নের তথা নিয়তির পথে শুন্য হাতে রওনা দিয়েও সফল হওয়া যায়- তা অনুধাবন করা যায়। যে কোনো স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভয়। প্রতিটি বড় ঝুঁকি বড় সাফল্য বয়ে আনে। বইয়ের মুখবন্ধে মানুষের ব্যর্থ হবার চারটি কারণ পড়লে মনে হবে এগুলো বুঝি আমার কথাই বলা হচ্ছে। আলকেমিস্ট না পড়লে অজানা থেকে যাবে- একজন লেখক কতটা গভীরভাবে মানুষের জীবনবোধকে তুলে আনতে পারে। কতটা সহজ ভাষায় পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন- তুমি ঠিক কী কারণে কখনোই সফল হতে পার না।
তিন. বাস্তবতাকে গভীরভাবে বুঝতে
উপন্যাসটি জীবনকে খুব সহজে বুঝতে সাহায্য করে। সান্তিয়াগোর প্রাত্যহিক জীবনের বর্ণনা পাঠককে নিজের জীবনের সাথে মেলবন্ধন তৈরিতে সাহায্য করবে। হৃদয়ের চাওয়া বা সত্যিকার কামনা আসলে মহাবিশ্বের বার্তা। সত্যিকার অর্থে জীবিত ব্যক্তিই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
চার. অন্তরাত্মার আহ্বান শুনতে
প্রত্যেকের অন্তরাত্মা তাকে স্বপ্ন পূরণের দিকে ধাবিত হতে আহ্বান করতে থাকে। সে ডাকে যদি কেউ সাড়া না দেয়, তবে অন্তরাত্মার আহ্বান ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়। তাই অন্তরাত্মাকে সজীব রাখতে এর আহ্বানে সাড়া দেয়া জরুরি।
পাঁচ. জীবনে গতিশীলতা আনতে
আলকেমিস্ট থেকে শিখবেন- বর্তমানে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়। জীবন একটা অনেক দীর্ঘ ভ্রমণ, যেখানে প্রতিটা মানুষ একটা নির্দিষ্ট চরিত্র পালন করছে। জীবন মানেই গতিশীলতা-সংগ্রাম। যখন নিজেকে ভালোর দিকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, তখন দেখবেন আশেপাশের সবকিছুর পরিবর্তন ভালো দিকে হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যক্তিই পৃথিবীর ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ভূমিকা পালন করে যা অনেকসময় সে নিজেও জানে না।
জীবনদর্শনের নানা দিকে সমৃদ্ধ বইটির অন্যতম মূল কথা- মন থেকে কিছু চাইলে পুরো বিশ্ব তা পেতে সাহায্য করে।
ছয়. স্বপ্ন পূরণের পদ্ধতি জানতে
কালজয়ী আলকেমিস্টের শিক্ষা হচ্ছে- নিজের স্বপ্ন বা লক্ষ্য পূরণের পথে লেগে থাকা। পৃথিবীটা যেমন আছে তেমনভাবেই মেনে নেবেন না। এটাকে নিজের মতো করে তৈরি করে নিন। জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো শিখতে হবে। জীবনে আসা সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। স্বপ্ন দেখা বন্ধ করবেন না।
সাত. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে
বইটি নিজের ভেতর এক ধরনের অনুধাবন তৈরি করে, যা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে বেশ সহায়ক। বইটি পাঠকের মনস্তত্ত্ব তথা পুরো জীবন বদলে দেবে। এ বইয়ের বেশ কিছু কনসেপ্ট যেকোনো ব্যক্তির সার্বিক জীবনযাপনের জন্য দিকনির্দেশনামূলক হতে পারে। যেমন- যখন সত্যিই কোনো কিছু চাইবে তখন তা অর্জন করতে সারাবিশ্ব তোমাকে সাহায্যের পরিকল্পনা করবে, পৃথিবী প্রত্যাশিত জিনিসটি পাইয়ে দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে। তাছাড়া, ভালোবাসা কখনোই তোমাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দেবে না। যদি তা তোমার লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক হয় তবে সেটি সত্যিকারের ভালোবাসা না।
আট. স্বপ্নের পথে চলতে
আশা-নিরাশার এই জীবনে আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিই। অনেক স্বপ্ন দেখি, তবে হতাশা নামের একধরনের ভাইরাসের কারণে আবার তা হারিয়েও ফেলি। স্বপ্নের পথে হাঁটতেই আমাদের যত আপত্তি। স্বপ্নপূরণের একাগ্রতা কিংবা ধৈর্য না থাকলে তা আজীবন অপূরণীয় থেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়গুলো মূলত উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে। আন্দালুসিয়ান বালক সান্তিয়াগো একজন ভ্রমণপিপাসু এবং স্বপ্নসন্ধানী চরিত্রের নাম। সান্তিয়াগো সেই শিশুকাল থেকেই ঈশ্বর ও মানুষের পাপ-পূণ্য সম্পর্কে জানার চেয়ে পৃথিবী সম্পর্কে জানাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। শুধু খাদ্য ও পানীয়ের জন্য জীবনযাপন- তার কাছে পশুজীবনের মতোই মনে হয়। উদ্যমী সান্তিয়াগো তার লক্ষ্যে অটুট থাকে। সে রাখালের জীবন বেছে নেয় লক্ষ্য পূরণে। বাবাও ছেলের ইচ্ছার কাছে হার মানতে বাধ্য হন। শুরু হয় সান্তিয়াগোর স্বপ্নের পথে চলা।
নয়. গন্তব্যে এগিয়ে যেতে
সান্তিয়াগো পৃথিবী ভ্রমণে যাত্রা শুরু করে। সঙ্গী একপাল ভেড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে ফেলে। জীবন সম্পর্কে ক্রমেই ধারণা বদলাতে থাকে তার। যাত্রাপথে রহস্যজনক কিছু ঘটনা, বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্য ও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা সে পায় সেটি হলো- কোনো লক্ষণ দেখেই ভালো কিংবা মন্দের পূর্বাভাস পাওয়া। চলার পথে নানা প্রলোভন, তবুও এগিয়ে যাওয়া। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে ভালোবাসার অনেক জিনিস পরিত্যাগ করে। আর এভাবেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা ধরা দেয় এক দিন।
দশ. মহাবিশ্বের ভাষা শিখতে
উপন্যাসের নায়ক কিশোর পরিশ্রমী-ধৈর্যশীল, সামনে এগিয়ে যায় বুদ্ধিমত্তা-প্রজ্ঞা দিয়ে। পথে পথে আক্রান্ত হলেও ভোলে না স্বপ্নের কথা। সমৃদ্ধির জীবন ছেড়ে সে ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয় দুর্গম সাহারা মরুভূমি। প্রকৃতির ইশারা থেকে ঠিক করে নেয় যাত্রাপথ। তবুও স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা এই কিশোর বিচ্যুত হয়নি তার বিশ্বাস থেকে। প্রকৃতির ইশারায় শান্ত, নিরাপদ মরুদ্যানকে বাঁচিয়ে দেয় শত্রুদের আক্রমণ থেকে। মরুভূমির নির্জনতা, বাতাসের মুখরতা আর ভেড়ার পালের অপরিসীম ধৈর্য্য তাকে শিখিয়েছে মহাবিশ্বের ভাষা। ওই ভাষায় সে কথা বলেছে আকাশের সাথে, সূর্যের সাথে। নিজেকে পরিণত করেছে প্রচণ্ড ঝড়ে।
পরিশেষে বলা যায়
আলকেমিস্টে রয়েছে জীবন-জগত-প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা, জ্ঞান তাত্ত্বিক-অধিবিদ্যক-নন্দনতাত্ত্বিক বিভিন্ন বক্তব্য ও দার্শনিক তত্ত্ব। উপন্যাসে বিশ্ব-আত্মা বা পরম আত্মার উপস্থিতি স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে- জীবাত্মা বিশ্ব-আত্মার অংশ এবং হৃদয়ের মাধ্যমে এ দুই আত্মা সম্পর্কিত। বিশ্ব-আত্মা, প্রকৃতির আত্মা ভাবের আদান-প্রদান করে। প্রেম এমন একটি বিষয় যা বিশ্ব-আত্মা থেকে নিঃসৃত। ভালোবাসার জন্য কোনো যুক্তির দরকার হয় না।
উপন্যাসে বলা হয়েছে যে, বিশ্বের সবকিছুর লক্ষ্য আছে। সবকিছু নিজেকে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করে এবং নতুন লক্ষ্য অর্জন করে। এ ধারা বিশ্ব আত্মার সাথে একীভূত হওয়া পর্যন্ত ক্রম-বিকাশমান। প্রেম হচ্ছে সেই শক্তি যা বিশ্ব আত্মাকে পরিবর্তিত ও বিকশিত করে। উপন্যাসে প্রেমকে দেখা হয়েছে একটি অনবদ্য শক্তি হিসেবে যে শক্তির বলে আত্মার উন্নয়ন ঘটে।