আনিসুর রহমান এরশাদ:::::::
কেউ বলেন চাকরি হচ্ছে আধুনিক দাসত্ব, কেউ বলেন চাকরিই হচ্ছে জীবনের সব। চাকরির জন্য কতকিছু! চাকরি মানেই নিরাপত্তার এক বটবৃক্ষ। মাস গেলেই নির্দিষ্ট অংকের বেতন, বছর ঘুরতেই প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্ট। কিন্তু ৯টা-৫টা অফিস সৃজনশীলতাকে গলাটিপে হত্যা করে। উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনাকে মেরে ফেলে। বড় হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ করে। বস না বানিয়ে অন্যের চাকর বানায়। জেগে ওঠার ক্ষমতাকে অবদমন করে। চাকরি যা দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নেয়। ৫০ হাজার টাকা বেতন দেয়ার বিপরীতে ৫ লাখ টাকা আয় করিয়ে নেয়। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানই শক্তি, সামর্থ্য, মেধা, সময় চুষে নেয়; প্রয়োজন ফুরালে ছুড়ে ফেলেও দেয়। আপনিই পারেন আপনাকে আধুনিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে। মনে রাখবেন দাসের জীবন কখনো স্বাধীন জীবনের মতো সম্মানজনক নয়।
চাকরির সন্ধানে সহায়তা করার মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই বলেই চাকরির বাজারে প্রতারণা বেশি৷ নিয়োগের বিজ্ঞাপন ভুয়া, কোম্পানি ভুয়া, চাকরি প্রত্যাশী আবেদনকারীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য লিখিত পরীক্ষা ও মেডিক্যাল চেকআপ সম্পন্ন করা, ঘুষ আদান প্রদান, ভুয়া নিয়োগপত্র নিয়ে বিড়ম্বনা অহরহ ঘটছে৷ বিভিন্ন কোম্পানির নামে আকর্ষণীয় অফিস নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনে লোভনীয় বেতনে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করেন চাকরিপ্রার্থীদের। ইন্টারভিউ নিয়ে চাকরিও দিতেন। চাকরির প্রলোভনে ‘সিকিউর’ জীবনের প্রত্যাশায় ‘সিকিউরিটি মানি’ দেওয়ার পর চাকরিপ্রার্থীরা বুঝতে পারতেন তারা প্রতারকদের খপ্পরে পড়েছেন। চাকরিতে যোগদানের দিন গিয়ে দেখেন অফিস তালাবদ্ধ! চাকরিদাতারা নতুন ঠিকানায়, নতুন নামে অফিস করে আবার দিয়ে যান চাকরির বিজ্ঞাপন। এ যেন চাকরি নিয়ে রমরমা বাণিজ্য। চাকরি দেয়ার নাম করে শুধু আর্থিক প্রতারণাই নয়, মেয়েদেরও ফাঁদে ফেলে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা আপত্তিকর কাজে।
চাকরি স্থায়ীকরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। চাকরি অস্থায়ী রেখে ফায়দা লুটে মালিক আর বঞ্চিত হয় চাকরিরতরা। দীর্ঘদিন ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী নিয়োগ দেয়ার নিয়মও মানা হয় না। পোশাক খাতের ৩২ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়োগ ও পরিচয়পত্র দেয়া হয় না। খুলনায় হিমায়িত চিংড়ি রফতানি শিল্পের ৯৭ শতাংশ শ্রমিককে নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। সরকারিভাবে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হলেও ২৩ শতাংশ কারখানা নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটিই দেয় না। ফলে নতুন মা হওয়ার পর নারীদের একটি বড় অংশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরির আগে- টাকা-পয়সা কেমন দেবে? এই প্রশ্নের জবাবটাই সহজে মিলে না। আর পরে কেমন আয় কর? এ প্রশ্নেও নিরব থাকতে হয় অথবা সরব হলে বলতে হয় অনেক কথা; বলা যায় না বেতনের অঙ্কটা। বেতন এতটাই কম যে, উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারেন না। অবস্থাটা এমন ব্যবসা ভালো চললে সব কৃতিত্ব পলিসি মেকারদের আর ফ্লপ করলে ব্যর্থতার সব দায়ভার অধীনস্তদের।যেসব বড় কর্তাদের অবস্থান এবং কর্মকাণ্ডের কারণে কর্মস্থলে সহকর্মীদের মুখ থেকে হাসি চলে যায় তারা অধম। বিস্ময়কর রকম দ্রুততায় মালিকের কাছের লোকে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা তেল দিতে সক্ষম চাটুকারদেরই একটু বেশি থাকে। যোগ্যতা ও দক্ষতার গুণেও কিছু হয় সেটা ব্যতিক্রমই বলা চলে। শুধু আঞ্চলিক পরিচয়ের সুবাদে আনাড়ি কারো বড় দায়িত্ব পাবার উপযুক্ত হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত মেলে অনেক অফিসেই।
বিস্ময়করভাবে নবাগতরা অনেক অফিসে অসহায় হয়ে পড়ে। অফিসগুলোতেও দুটো ভাগ। একদল নেওয়ার পক্ষে, আরেক দল বিপক্ষে।এই পক্ষ-বিপক্ষের কারণ নতুনের সম্পর্কে ভালো-মন্দ মূল্যায়ন নয়। পক্ষ-বিপক্ষের বিভক্তি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একদল আওয়ামীপন্থী, আরেক দল আওয়ামীবিরোধী। কে কার মাধ্যমে এসেছে সেটাই যেন মূখ্য, অথচ মাধ্যমের মতাদর্শ থেকেও যে ভিন্ন হতে পারে যিনি এসেছেন তার মতাদর্শ; এই ভাবনা যেন অনুপস্থিত।
বিশেষ করে সাংবাদিকদের বাজারমূল্য অনুসারে ন্যায্য মজুরি পাওয়া নিয়ে ভাবাটাও অনেক হাউজে দৃষ্টিকটু বলে বিবেচিত হয়। ভাবটা এমন যে- অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করবে সাংবাদিক, তার নিজের কোনো অধিকার থাকতে নেই। অনেকে যা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চলে না! তারপরও বিনাবেতনে, অনিয়মিত বেতনে অথবা পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে হঠাৎ চাকরিচ্যুত করা হয় তখন ভুক্তভোগীর জীবন চালানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে, জীবন হয় কষ্টেগাথা।
বাংলাদেশে অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে নানা ধরণের প্রভাব খাটিয়ে একটা সাইনবোর্ড জোগাড় হয়, কিন্তু সেখানে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়ার আন্তরিক চেষ্টা বা সাধ্য থাকে না৷ প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, পেশার জন্য জীবন বাজি রেখেও অনেক সংবাদকর্মীর যে দেশে আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং জীবনের নিরাপত্তা মেলে না; সেই দেশে ‘সাইনবোর্ডসর্বস্ব’ প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত কিছু সাংবাদিকের জীবন কাটে মহাসুখে৷
এই দেশে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশায় থেকে বেতন না পেতে-পেতে এক পর্যায়ে দেশান্তরি হবার ঘটনাও ঘটেছে। আনমনা চলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় কিংবা রোগে অকালমৃত্যুও ঘটেছে। কাউকে ভাবের ওপরে আর কাউকে হাওয়ার ওপরেও চলতে হয়। অনেক মিডিয়া হাউজের ভেতরের অবস্থা বাস্তবে এমন যে ওপর দিয়ে ফিটফাট ভেতর দিয়ে সদরঘাট। এমনও হাউজ আছে যেখানে কিছু সাংবাদিককে বেতন দেয়া হয়, বাকিরা বেতন ম্যানেজ করে চলেন! নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় মানসিক যন্ত্রণায় অনেকে অসুস্থ হন।
অনেক সাংবাদিক বেতন না পাওয়ায়, ন্যায্য বেতন না পাওয়ায় অথবা নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়ান! অনেক সাংবাদিকের চাকরি বড় অদ্ভুত। ‘এ যুগের দাস’-এর চাকরিতে উপস্থিতিতে বিলম্ব হলে বেতন কর্তন হয়, বছরের পর বছর গেলেও চাকরি কনফার্ম করে না, কোন ছুটি-ছাটা থাকে না। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, মায়ের অসুস্থতায় গ্রামের বাড়ি যাওয়া, এমনকি বিয়ে করতে গিয়েও ছুটি মেলে না।
অনেকে সাংবাদিকদের বিনা বেতনে কাজ করাতে পারলে এই বসুন্ধরায় জন্ম নেয়া স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করেন। যারা ওপরে থেকে বেশ ফুরফুরে আমেজে থাকেন তাদের পর্যন্ত পৌঁছে না অধঃস্তন সাংবাদিকদের সংসারের কান্না! এখন পর্যন্ত অষ্টম ওয়েজবোর্ডও বাস্তবায়িত হয়নি অধিকাংশ পত্রিকায়। এমনও পত্রিকা আছে যারা বিস্তর সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার পরও সেখানকার সাংবাদিক কর্মচারীদের নিয়মিত বেতনভাতা দেয় না। বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ পত্রিকাই সাংবাদিকদের উপযুক্ত বেতন দেয় না অথবা নিয়মিত দেয় না!
কয়টা টিভি চ্যানেল তার সাংবাদিক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দেয়? অনলাইন পত্রিকাগুলো কি তার স্টাফদের উপযুক্ত অথবা নিয়মিত বেতন দিচ্ছে? অস্ট্রেলিয়ায় একজন জুনিয়র রিপোর্টারকে সপ্তাহে সাড়ে সাতশ ডলারের নিচে বেতন দেওয়া যায় না। এজন্যে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে পত্রিকা-টিভি চ্যানেলের সংখ্যা হাতে গোনা। একজনকে ন্যায্য বেতন দিতে না পারলে উল্টো মোটা জরিমানা দিতে হয়!
অথচ বাংলাদেশে দেশব্যাপী খোলা হয়েছে মিডিয়া! ব্যাংক সলভেন্সি দেখিয়ে ডিক্লারেশন নেওয়া হয়, পত্রিকার অফিস ভাড়া দিতে টাকা লাগে, কাগজ কিনতে প্রেসে টাকা লাগে কিন্তু প্রোডাক্ট যারা তৈরি করেন, সেই সাংবাদিকদের বেতনের খবর নেই। সারা দুনিয়াতে সংবাদপত্র তথা মিডিয়া একটি ব্যবসা, এর পেছনে বিনিয়োগ জড়িত। অথচ এদেশে ধান্ধাবাজ ও ধূর্ত প্রকৃতির অনেকে অপরাধ ও অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে মিডিয়া চালু করেন। আশা দিয়ে এসবে জড়িত করেন হাজার হাজার সাংবাদিককে।
ঢাকার লোকজন অফিস থেকে বেতনসহ কিছু পায়। ঢাকার বাইরের ৯৯ ভাগ অথবা এরচেয়ে বেশি সাংবাদিক তা পায় না! এমন একটি পন্থা বের করা দরকার যাতে দেশে একজন সাংবাদিকও বাজারমূল্য অনুসারে ন্যায্য মজুরি ছাড়া কাজ করতে না হয়। বাজার চাহিদা অনুসারে দেশে কতটি সংবাদপত্র, টিভি, অনলাইন চলা সম্ভব সেটিও ঠিক করে এমন একটি অবস্থা নিশ্চিত করা দরকার, যেন নির্ধারিত বেতনভাতা দিতে না পারলে, কেউ কোনো মিডিয়া দোকান খুলতে ও চালাতে না পারে। অপ্রয়োজনীয় ধান্ধাবাজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কাম্য হতে পারে না।
আলাপচারিতায় এক সাংবাদিক বন্ধু জানালেন- সাত মাসের বেতন বকেয়া, বউ চাকরি করে বলে রক্ষা! আর এক অবিবাহিত সাংবাদিক বন্ধুর কথা, আমার পত্রিকায় তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ। সংসার করলে এখন কাপড় খুলে রাস্তায় হাঁটতে হতো৷ এসব সঙ্কটের সাথে ভুয়া সাংবাদিকতার বিশাল নেটওয়ার্ক যোগ হয়ে অবস্থা আরো খারাপ করেছে৷
আসল সাংবাদিকের জীবন যেখানে শঙ্কিত সেখানে ভুয়া সাংবাদিকরা চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, জমি দখল থেকে শুরু করে হেন অপরাধ নেই যা করে না৷ আর নামকাওয়াস্তে মিডিয়া খুলে বসা মালিকরাও ওয়েজ বোর্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজস্ব নিয়মে নিয়োগপত্র প্রদানসহ দাসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিয়মগুলোকে সাংবাদিকদের মানতে বাধ্য করে থাকেন। এভাবেই এই সময়ে এসেও নীলকর, জমিদারদের প্রেতাত্মা মালিকদের অন্যায় সিদ্ধান্ত ও খেয়ালিপনার শিকার হয়ে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে পেশাদার, দায়িত্বপরায়ণ ও সৎ চাকরিজীবীরা।
সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য সেক্টরেও রয়েছে নানা অনিয়ম।পরিকল্পিত ছাঁটাইযজ্ঞে ছাঁটাই আতঙ্কে বিপাকে পড়ে অনেকের আশার গুড়েবালি হয়। প্রতিষ্ঠানের লাভের একটি অংশ কর্মীদের দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় না।ব্যাংকিং খাতে ছাঁটাইয়ের প্রবণতা বেড়েছে। গণহারে ছাটাই না হলেও পুরো বছরেই দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ছাঁটাই কার্যক্রম চলে। ছাঁটাই করতে কখনো পরীক্ষা কখনো বদলির কলা-কৌশলের আশ্রয় নেয় ব্যাংকের নেতৃত্বে থাকা লোকজন। দুটি ঘটনা ব্যাংকপাড়ায় বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। একটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত একজন কর্মকর্তার পাগল হয়ে যাওয়া, আরেক ব্যাংকের একজনের হার্ট অ্যাটাক করা।
প্রতিষ্ঠানকে আরো লাভজনক করতে ব্যয় সংকোচন নীতি বাস্তবায়নের ফলে গ্রামীণফোন ২০০৯ সালে প্রায় দেড় হাজার কর্মী একসাথে ছাঁটাই করেছিল, বিপাকে পড়েছিল পার্টটাইম ও অনিয়মিত কর্মীরা। কর্মীদের আন্দোলনের মুখে তাদের পুনর্নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকে নতুন নেতৃত্ব আসায় শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে সকল স্তরে চাকরি হারানোর ভয় বাড়তে শুরু করে। গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের পরে ইসলামী ব্যাংকে ছাটাই আতঙ্ক বন্ধ হয়। এরপরেই ছাঁটাই আতঙ্কে ভুগতে শুরু করে এনসিসি ও ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বাদ যায়নি নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ও এনআরবি ব্যাংক।
টেকনোলজি বিভাগ আউটসোর্সিং সিস্টেমে চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকে বাংলালিংকের কর্মীদের মাঝে ছাঁটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কথা গণমাধ্যমে এসেছে।ছাঁটাইয়ের জন্য নানান অযুহাত দাঁড় করানো হয়, ছোটখাটো কারণে সব ধরনের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রাখা হয়। সার্ভিস রুলস মানা হয় না, অধিকার বঞ্চিত করা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের শিরোনামগুলোই স্পষ্ট করে ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক! যেমন- ‘যমুনা টিভিতে আবার ছাঁটাই আতঙ্ক’ ‘একমি ল্যাবরেটরিজে ছাঁটাই আতঙ্ক’ ‘এনসিসি ব্যাংকে ছাঁটাই আতঙ্ক থামেনি!’ ‘ছাঁটাই আতঙ্কে পল্লী বিদ্যুতের ২২৯ কর্মী’ ‘একমি ল্যাবরেটরিজে ছাঁটাই আতঙ্ক’ ‘ছাঁটাই আতঙ্ক: আবারো অস্থির পোশাক খাত’ ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ছাঁটাই আতঙ্ক’ ‘বেসিক ব্যাংকে ছাঁটাই আতঙ্ক’ ইত্যাদি।
কোনো পূর্ব নোটিস ছাড়াই ব্যাপকহারে কর্মী ছাঁটাই হয়। কোনো সতর্কতামূলক চিঠি না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত করে বিদায় দেওয়া হয়। মৌখিকভাবে পারফরম্যান্স ভালো করার পরামর্শ দেয়ার পর সকালে অফিসে গেলেই আকস্মিকভাবে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি জানানো হয়। অভ্যন্তরীণ রদবদল ও অনেকের পদ অবনমন করা হয়। কর্মীদের ছাঁটাই প্রক্রিয়া কার্যকর করতে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এমনকি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থাইল্যান্ড থেকে তৈরি করে নিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে। উধ্বর্তন অফিসারদের এক ঘণ্টায় ৩০০টি এবং জুনিয়র অফিসারদের একই সময়ে ১৫০টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নিয়ম করা হয়। এই ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট টেস্টে’ কেউ অকৃতকার্য হলেই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
চাকরি বিধিমালার কোন রকম তোয়াক্কা না করেই চাকরি ছাড়াতে কর্মকর্তাদের বাধ্য করা, কোন পূর্ব ঘোষণা বা নোটিস না দিয়ে জোর করে পদত্যাগ (রিজাইন) করতে বাধ্য করা আর পদত্যাগ না করলে তাদের ছাঁটাই (টারমিনেট) করা হবে বলে হুমকিও দেয়ার ঘটনা কম নয়। কর্তৃপক্ষ যখন গোপন তালিকা তৈরি করেন, তালিকা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাদের চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাঁটাই প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে পরীক্ষা নেন; তখন সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্ম পরিবেশ বজায় থাকে না। অনেক সময় পদত্যাগে বা রিজাইন দিতে রাজি না হলে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়, নিজেদের স্বার্থে যোগ্যদের বাদ দেয়ার নকশাও তৈরি করা হয়, ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ঊর্ধ্বতন নাখোশ হওয়ায় কালো তালিকায়য় পড়তে হয়। ছাঁটাই আতঙ্কে অনেক বিক্ষোভও করেন। অন্যত্র বদলির কথা বলে ছাঁটাইয়ের কৌশলও চলে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘ব্র্যাক ব্যাংকে ‘ফ্রেশ ব্লাড’ পলিসি, আতঙ্কিত কর্মীরা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আছে- ‘নিজেদের ক্লিন ইমেজ বজায় রাখতে প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদত্যাগপত্র প্রদানে বাধ্য করা হয়, চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। তাদের রিজাইন লেটার দিতে বলা হয়, যাতে করে কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে আটকে না যায়। তারাও ভয়ে সেটা দিয়ে দেন। কারণ তা না দিলে তো ব্যাংকের সঙ্গে যা কিছু দেনা-পাওনা থাকে, তা-ও পাওয়া যাবে না। পুরোনো কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করে নতুনদের নিয়োগ দেওয়ার প্রচলিত নীতিকে ‘ফ্রেশ ব্লাড’ পলিসি হিসেবে দেখা হয়। ব্যাংক এ বিষয়টিকে ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হিসেবে দেখলেও পুরানো কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক লেগেই থাকে।’
‘বাড়ছে কম্পিউটারের ব্যবহার, চলছে কর্মী ছাটাই’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আছে- আকিজ গ্রুপ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৭০০ জন কর্মীকে ছাটাই করেছে। ব্রাকেরও কর্মী ছাটাইয়ের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে দেশের দুই মোবাইল অপারেটর রবি এয়ারটেল একীভূত হওয়ার পর অনেক কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এসব ছাটাইয়ের কারণ হিসেবে ডিজিটালাইশনের প্রভাব পাওয়া গেছে। অনেকে ধারণা করছেন প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার বাড়লে কর্মী ছাটাইয়ের সংখ্যা আরো বাড়বে।
চাকরির জগতটা বড় অদ্ভূত। অনেকের নাকি ভিজিটিং কার্ড আর আইডি কার্ড হলেই চলে! বেতন ছাড়াই চলার টাকা কামায়ে নিতে পারেন! চাকরির জন্য ১০ টাকা ঘুষ দিতে পারেন, উদ্যোক্তা হতে ৫ টাকা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে পারেন না! অনেকে আছেন কয়েক মাস ধরে বেতন পান না, তবু সঠিক সময়ে অফিসে এসে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনে সচেষ্ট থাকেন! অনেকে ধার করে চলেন, অনেকে হাওয়া-বাতাস খেয়ে বাঁচেন! পেটে ভাত না থাকলেও উর্ধ্বতনকে সন্তুষ্ট রাখতে তৈলাক্ত প্রশংসা করে হাসেন! উর্ধ্বতনদের খেতে দেখেই যারা না খেয়েও তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন তারা সাধারণ কোনো মানুষ নন! এরা জগতের বড় বিস্ময়! আজব প্রাণী! ধমক খেয়েও মুচকি হেসে যারা জীবন কাটান, তাদের জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত আনন্দ কোনোদিন আসে না। চাকরির লোভ আছে বলেই প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ বৈধতা পায়, সুবিধাভোগী ও বঞ্চিতরা এক কাতারে মেশে। স্বপ্নপূরণের আনন্দ আর স্বপ্নভঙ্গের কান্না একসাথে হাসে। আর পাওয়া-হারানোর খেলার ভেলায় বিজয়ী-পরাজিতরা ভাসে! চাকরের চাকরগিরি যখন নেতাগিরিতে রূপ নেয় তখন তা বড়ই চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। চারপাশের বিপুল মানুষকে বিনোদিত করে তা আধুনিক দাসত্বের চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে অনেকের মনে জায়গা করে নেয়।