স্বাস্থ্য বিষয়ে ২১টি কমন সেন্স

মাশাহেদ হাসান সীমান্ত
——————————————
আমি গত মাসে ২১ দিন বাবার সাথে হাসপাতালে ছিলাম। এখন তিনি আছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। প্রতিদিন অনেক কিছু শিখেছি। আজ শেয়ার করছি সেই ২১ দিনের ২১টি শিক্ষা, যা আপনাদের কাজে লাগতে পারে।
—————————————-

যখন সুস্থ আছেন

১। সুস্থ থাকলেও প্রতি ৩ মাসে একবার করে ডাক্তারের কাছ গিয়ে নিজেকে চেক-আপ করান। অন্তত নিজেদের পরিবারের পরিচিত কোনও ডাক্তার থাকলে তার কাছে হলেও চেক-আপ করিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, আমাদের বাহ্যিক সুস্থতার মাঝেও অনেক অসুস্থতা লুকিয়ে থাকে।

মনের জোর দিয়ে কাজের শক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু শরীরের সুস্থতা না। আর অসুস্থতাকে এড়িয়ে চললেই তার সমাধান হয় না।

২। মেডিসিনের কোনো কোর্স শুরু করলে ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া মাঝ পথে খাওয়া ছেড়ে দেবেন না।

একটা সহজ উদাহরণ দেই- মনে করেন, আপনার শরীরের ভেতরে ১০০টা জীবাণুর উপস্থিতির জন্য আপনি অসুস্থ হলেন। ডাক্তার আপনাকে ৩০ দিন মেডিসিন খেতে বলল। প্রথম ৭ দিনেই আপনার শরীরের ৮০টি জীবাণু ওষুধের কারণে ধ্বংস হয়ে গেল, যেহেতু অধিকাংশ জীবাণু মারা গেছে, তাই আপনি সুস্থ ফিল করা শুরু করে মাঝপথেই মেডিসিন নেয়া ছেড়ে দেবেন।

এতে সমস্যা কী হবে জানেন, যেই ২০টা জীবাণু বেঁচে আছে, তারা নিজেরা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট অনুসারে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ যে ওষুধ তাদের ৮০ স্বজাতিকে মেরেছে, তারা এমন কৌশল তৈরি করবে যাতে একই অস্ত্রে তারা আবার মারা না যায়। তারা ঔষধটাকে চিনে ফেলে, আর নিজেদেরকে সেই ঔষধটা মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তোলে আর বংশ বৃদ্ধি করে।

একারণেই অনেক ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন, পুরনো ঔষধে পুরনো রোগ সারে না কিংবা সামান্য অসুখের জন্য অনেক বেশি পরিমাণ চিকিৎসা লাগে।


ডাক্তারদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন

হাসপাতালে করণীয় (রোগীর পরিবার)

৩। প্রথম অনুরোধ, ডাক্তারদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। আমি জানি, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে কেমন লাগে। কিন্তু নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ না রেখে যদি ডাক্তারের সাথেই খারাপ আচরণ করেন, তাহলে তিনি চিকিৎসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। ডাক্তারের ব্যবহার খারাপ হতে পারে, কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবেন, ওই মুহূর্তে ওই জায়গায় হয়তো একমাত্র উনিই আপনাকে জ্ঞান আর দক্ষতা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন; আর কেউ না।

আর আপনি হয়তো আপনার পেশেন্টকে নিয়ে চিন্তায় আছেন, ডাক্তার সাহেবকে এরকম আরও অনেক পেশেন্টে এক দিনে ডিল করতে হয়। তাঁর অবস্থাটাও বোঝার চেষ্টা করুন।

যদি মনে হয়, অভিযোগের বিকল্প কিছু নেই, তাহলে মেডিকেলের প্রশাসনের কাছে যান। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, কোনটা অভিযোগের সময় আর কোনটা চিকিৎসার। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত আপনার।

৪। নার্স আর মেডিকেল স্টাফদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। র‍্যাংক দিয়ে তাদের বিচার করবেন না। প্রতি রাতে যখন ডিউটি ডাক্তাররা থাকবেন না, তখন এই নার্সরাই রাত জেগে থাকবে, হঠাৎ কোনো প্রয়োজনের জন্য।

৫। এক রোগীর সামনে অন্য রোগীর ভালো কিংবা খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন না। ভালো অবস্থা শেয়ার করলে রোগী নিজের অসুস্থতার কথা ভেবে নিজেকে তুলনা করে কষ্ট পাবেন, আর খারাপ অবস্থা আলোচনা করলে ভয় পেয়ে যাবেন।


এক রোগীর সামনে অন্য রোগীর ভালো কিংবা খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন না

৬। রোগী যদি একটু হাঁটা-চলা করতে পারেন তাহলে তাকে সুস্থ বিনোদনের সাথে রাখুন। হতে পারে তাকে তার পছন্দের বই এনে দিন, কিংবা পছন্দের গান শোনান। মোট কথা তার মন ভালো রাখুন। অসুস্থতার সময়গুলো অনেক দীর্ঘ লাগে, তাকে সময় দিন।

৭। যদি আপনার কেউ কোনো জটিল রোগে পতিত হয় তাহলে ডাক্তাররের কাছ থেকে রোগের নামটা জেনে সেই রোগ নিয়ে নিজে একটু ইউটিউবে পড়াশুনা করুন। এই পড়াশুনায় আপনি হয়তো ডাক্তার হবেন না, কিন্তু অন্তত ডাক্তারের দেয়া নির্দেশনাগুলো ভালোভাবে বুঝবেন।

অনেকক্ষেত্রে ‘আপনি হয়তো ঠিকমত বুঝতে পারবেন না’, এই ভেবে অনেক ডাক্তার আপনার কাছে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করবেন না। আপনি যদি চান সেগুলো বুঝতে, একটু রোগগুলোর লক্ষণ, চিকিৎসা চলাকালীন কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কিংবা এর সম্ভাব্য চিকিৎসাগুলো কী কী; একটু নিজে থেকেও পড়াশুনা করে ধারণা রাখুন। কাজে দেবে অনেক।

৮। রক্তের প্রয়োজন হলে ফেসবুকে যারা যারা রক্ত দিতে আগ্রহী, তাদের নাম , কোন জায়গা থেকে আসবেন (আসতে কেমন সময় লাগে বোঝার জন্য), ফোন নাম্বার, একটা রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখুন। যাতে করে রক্তের জন্য সবাই একটা ফেসবুক একাউন্টের উপরে নির্ভর না করে।

১০। হঠাৎ কেউ রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে আমাদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এত এত খরচ হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে আমরা হিসাব রাখতে পারি না। সেই সময়ের অনেকের থেকে সময়ের প্রয়োজনে আমরা ধার নেই। সেগুলো দয়া করে লিখে রাখুন। সব মনে রাখতে পারবেন না। অযথা বেশি মানসিক চাপ নেবেন না।

১১। সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের সফট কপি স্ক্যান অথবা ভালো রেজুলুশনে ছবি তুলে পিডিএফ করে একটা সিংগেল ফাইল বানিয়ে রাখুন। যাতে দেশের ভেতরে বা বাইরে কোথাও রেফার করা লাগলে দ্রুত দিতে পারেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি রিপোর্ট থাকলে ১/২ পেজের একটা কেস সামারিও নিয়ে রাখুন। কাজগুলো ছোট, কিন্তু জানা থাকলে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সময় বাঁচবে।

ফাইলের নাম এভাবে লিখতে পারেনঃ
রোগীর নাম – রোগ – বয়স
Mashahed Simanta–Aplastic Anemia–25

এভাবে নাম লিখলে ডাক্তার শুধু ফাইলের নাম দেখেই দ্রুত অনেকটা বুঝে নেবে।

হাসপাতালে করণীয় (দর্শনার্থী)

১২। রোগীর জন্য খাবার নেয়ার সময় একটু সতর্ক হোন। সব খাবার রোগীর জন্য এলাউড না। যেহেতু হাসপাতালে রান্নার সুব্যবস্থা নাও থাকতে পারে, তাই আপনি চাইলে রোগীর পরিবারের জন্য খাবার নিয়ে যেতে পারেন। তাদের কষ্টটা কমবে। আর রোগীর জন্য কোনও খাবার নিতে চাইলে বিশেষ সতর্কতার সাথে বাছাই করুন।

১১। বিয়ের সময়তো আমরা অনেককে অনেক অর্থ উপহার হিসেবে দেই। বিয়েটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। কিন্তু অসুস্থতা পরিকল্পিত নয়, বরং বিয়ের আনন্দের চেয়েও সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিয়েগুলোতেই সব টাকা শেষ না করে চিকিৎসার জন্যও কিছুটা রাখুন। ফাইনানশিয়াল সাহায্যগুলো পরিবারগুলোকে অনেক শক্তি দেয়।

বিদেশে চিকিৎসায়

১৩। যদি এমন কোনো একটা দেশে চিকিৎসা নিতে যেতে চান যেখানে ইংরেজির প্রচলন বেশি, সেখানে চেষ্টা করুন ভালো ইংরেজি পারে এমন কাউকে সাথে রাখতে। অনেক হাসপাতালে অনুবাদকও পাওয়া যায়, যদিও সেটার আলাদা খরচ আছে।

১৪। নিজের পরিবারের যদি কেউ ডাক্তার থাকে, তাকে সাথে রাখার চেষ্টা করুন, সে জুনিয়র ডাক্তার হতে পারে কিংবা পড়াশুনা শেষ হয়নি- এমনও হতে পারে, কিন্তু তারা ইন্সট্রাকশনগুলো দ্রুত ধরতে পারে। আর সাথে একজন ডাক্তার আছে, এই চিন্তাটাই রোগীকে অনেক শক্তি দেয়।

হাসপাতালের বাইরে

১৫। রাস্তায় চলার সময় কোনো এম্বুলেন্স দেখলে তাকে সাইড দিন। হয়তো আপনি পাঠাওয়ের বাইকে যাচ্ছেন, এম্বুলেন্স কাটিয়ে বাইক এগিয়ে যেতে পারে, তবুও একটা এম্বুলেন্সের সামনে বাধা তৈরি করবেন না। আপনার জন্য জ্যামে ১/২ মিনিট তেমন কিছুই নয়, রোগীর জন্য অনেক কিছু। আপনার রাইডার যদি নিজে থেকে এম্বুলেন্সকে যেতে দেয়, রাইড শেষে তাকে ঠিক সে কাজের জন্য ধন্যবাদ দিন। তাকে স্পেসিফিকভাবে কাজটা মনে করিয়ে দিন।
সবাই হয়তো সাইড দেবে না, কিন্তু অন্তত আপনি শুরু করুন।

১৬। কেউ যদি আপনাকে কোনো হাসপাতালের ঠিকানা জিজ্ঞেস করে, আপনার হাতে সময় থাকলে তাকে হাসপাতালের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিন। আমি অনেক মানুষ দেখেছি, যারা প্রিয়জনের সাথে আর কয়েকটা দিন একসাথে পথ চলার জন্য হাসপাতালে আসেন, তারা হয়তো লোকেশন বোঝেন না , ব্লক, কেবিন, ওয়ার্ড বোঝেন না; তাদের কাজগুলো একটু সহজ করে দিন।

সুস্থ হবার পর

১৭। যারা যারা আপনার প্রিয়জনের জন্য রক্ত দিয়েছেন, তাদের সাথে দেখা করুন, তাদের ধন্যবাদ দিন।

১৮। যেই ডাক্তার আর নার্স আপনাদের পাশে ছিল তাদের ধন্যবাদ দিয়ে আসুন, হয়তো সেই দিনও তারা অন্য কোনো রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, কিন্তু মানুষ হিসেবে ১/২ মিনিটের কৃতজ্ঞতাগুলো পাবার দাবি তারা রাখেন।

১৯। কেন আপনি রোগে পড়েছিলেন; আর কী কী করলে এই রোগ থেকে আপনি বেঁচে থাকতে পারতেন, এটা শেয়ার করুন। সবার হয়তো কাজে লাগবে না, কিন্তু কারো না কারো কাজে দেবে।

২০। হঠাৎ করে যদি দেখেন ১ ঘন্টা সময় পেলেন, কিছু একটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তখন হাসপাতালে যান। টাকা দিয়ে না পারেন, ডাক্তারি জ্ঞান দিয়ে না পারেন, কোনোও এক বৃদ্ধা যদি তাঁর অসুস্থ স্বামীকে ধরে রাখার মতো শারীরিক শক্তি না পান, তার পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়ান। হয়তো এতে অসুস্থ মানুষের শারীরিক সুস্থতা চলে আসবে না, কিন্তু এটা ‘বেটার দ্যান জিরো’।

২১। আপনার শরীর এমন একটা জায়গা, যেখানে আপনি সারা জীবন বসবাস করবেন। সুস্থতার জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। নিজের জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা অন্যদের চেয়ে বেশি সুস্থ রাখে।

লেখক : প্রশিক্ষক ও পার্সোনাল কোচ

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top