এম এ মুহিত
সেই ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে টানে। দিগন্তজোড়া সবুজ ফসলের মাঠ, বনজঙ্গল, গাছ, পাখি, নদী, নদীতে বয়ে চলা পালতোলা নৌকা ইত্যাদির সৌন্দর্য
উপভোগ করি। এখনো এসব আমাকে সমানভাবে টানে। কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে বারবার প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই। প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করি সাঁতার কাটা ও নৌকা বাওয়া। আমি আমার ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকি। যখন কোনো মানুষ তার ভালো লাগা বা ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারে তখন তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ছোটবেলা থেকেই আমি সব সময় খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। শরীরটা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’ গল্পের মতো খুব বাজে রকমের ভালো।
ছোটবেলা থেকেই আমি বেড়ে উঠেছি পুরান ঢাকার কোতোয়ালি রোডে। তরুণ, স্বপন, সুব্রত, প্রশান্ত, অনিরুদ্ধ, নারায়ণ, বিধান, সোহরাব—এরা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমরা সবাই একই স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছি। একই সঙ্গে খেলাধুলাও করেছি। আমাদের ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক বাসুদার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে ওসমানী উদ্যানে গিয়ে ব্যায়াম করতাম, যা এখনো ধরে রেখেছি। আমি জীবনে শখ করেও কোনো দিন ধূমপান কিংবা মদ্যপান করিনি। শরীর সুস্থ রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই।
ঈদ-পূজার ছুটিতে বন্ধুরা মিলে বেরিয়ে পড়তাম কয়েক দিনের সফরে। মা-বাবা বলতেন, ঈদের সময় তাঁদের সঙ্গে থাকতে। আমি তখন তাঁদের বোঝাতাম যে আমার ভালো লাগার কাজগুলো আমি করতে চাই। তা ছাড়া আমি এমন কোনো কাজ করছি না যাতে তাঁদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তখন কয়েকটা প্রাইভেট টিউশনি করতাম। সেখান থেকেই আমার ভ্রমণের খরচ মেটাতাম। তা ছাড়া আমি সব সময় মাটির ব্যাংকে টাকা-পয়সা জমাতাম এবং ভ্রমণে যাওয়ার সময় সেই ব্যাংক ভাঙতাম। এখনো আমি ভ্রমণের উদ্দেশে মাটির ব্যাংকে টাকা-পয়সা সঞ্চয় করি। তখনকার ভ্রমণ ছিল আর সবার মতোই বাস-ট্রেন বা লঞ্চে চড়ে পরিচিত কোনো জায়গায় যাওয়া। অফ ট্রেইলে ভ্রমণ তখনো শুরু হয়নি।
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে পরিচয় হয় সদ্য অ্যান্টার্কটিকা ফেরত অভিযাত্রী ইনাম আল হকের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে বদলে যায় আমার জীবন। তিনি আমাকে কাছে টেনে নেন এবং ধৈর্য নিয়ে পাখি, প্রকৃতি, অ্যাডভেঞ্চার, ফটোগ্রাফি ছাড়াও সততা, ভদ্রতা, মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান ও পরামর্শ দিতে থাকেন। আমিও অনুগত ছাত্রের মতো তাঁর শিক্ষা আত্মস্থ করি।
প্রতিটি মানুষই কোনো বিশেষ প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। শৈশব থেকেই তার যত্ন নেওয়া উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের অধিকাংশ বাবা-মা ও শিক্ষকেরা শিশুর প্রতিভা বোঝার পরিবর্তে সব শিশুকেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান।
আমি বুঝতে পারতাম, আমার মধ্যে একটা শক্তি লুকিয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে তা কাজে লাগাতে হবে তা জানতাম না। ইনাম আল হক তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে আমার মধ্যে দেখতে পান বড় কিছু করার ক্ষমতা এবং তিনি তা বের করে আনতে সক্ষম হন। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমাদের দেশে ইনাম আল হকের মতো মেনটর খুবই প্রয়োজন।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার ঈদের ছুটিতে আমরা ১২ বন্ধু যাই সিলেটে। তখন মৌলভীবাজার জেলার মাধবকুণ্ড ঝরনার ২০০ ফুট ওপরে যেখান থেকে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ে সেখানে উঠে আমরা সবাই বেশ রোমাঞ্চিত হই। সেটি ছিল আমার জীবনে প্রথম কোনো পাহাড় বেয়ে ওঠা। এরপর একই বছরের অক্টোবর মাসে দুর্গাপূজার ছুটিতে ১০ বন্ধু মিলে যাই বান্দরবান-রাঙামাটি-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড়ে (প্রায় এক হাজার ৮০০ ফুট) সবার আগে এক ঘণ্টায় উঠে বেশ গর্ব হচ্ছিল। তারপর থেকে পেয়ে বসে পাহাড়ে চড়ার নেশা। ২০০১ সালে পাখি দেখতে ইনাম স্যারের সঙ্গে বান্দরবানের এক পাহাড়ে ট্রেকিং করি। এরপর থেকে প্রতিবছর দুই-তিনবার করে বান্দরবান ও রাঙামাটি যেতে থাকি। আমাদের দেশের শীর্ষ সব চূড়ায় যখন ওঠা হয়ে গেল, তখন আমাদের ইচ্ছা জাগল আরও উঁচুতে ওঠার। তাহলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট নয় কেন? এই লক্ষ্য সামনে রেখে অ্যান্টার্কটিকা ও উত্তর মেরু অভিযাত্রী প্রথম বাংলাদেশি ইনাম আল হকের নেতৃত্বে ২০০৩ সালে গঠন করা হয় বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব (বিএমটিসি)। এই ক্লাব গঠনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো। শুধু দল গঠন করলেই তো আর হলো না, পর্বতারোহণের জন্য এর অ-আ-ক-খ শিখতে হয়, কলাকৌশলগুলো রপ্ত করতে হয়। সেই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেই ২০০৪ সালের মে মাসে অভিযাত্রী ইনাম আল হকের নেতৃত্বে এভারেস্টের প্রবেশদ্বার বেসক্যাম্পে গিয়েছিলাম আমরা ছয় বাংলাদেশি। নেপালের লুকলা থেকে ট্রেইলে আমাদের পথ চলা শুরু হয়। ১০ দিনে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ হেঁটে আমরা প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় বেসক্যাম্পে পৌঁছাই।
এভারেস্টকে কাছ থেকে দেখার পর তাতে চড়ার ইচ্ছা আরও প্রবল হলো। এখন প্রয়োজন পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কীভাবে বরফে ও পাথরের ঢালে আরোহণ করতে হয় তার প্রশিক্ষণ। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সেশনে আমি মৌলিক পবর্তারোহণ প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে (এইচএমআই) যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি। কিন্তু কোর্সের পুরো ফি জোগাড় না হওয়ায় অনিশ্চয়তায় পড়ে যাই। আমার সঞ্চয়ে ছিল অর্ধেক। প্রতি মাসের তৃতীয় বুধবার ইনাম আল হকের বাসায় যারা ট্রেকিং করতে পছন্দ করে তাদের একটা আড্ডা হয়। সেদিনের সেই আড্ডায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সবাই মিলে আমার প্রশিক্ষণের অবশিষ্ট টাকা তুলে দিলেন। সেবার সফলতার সঙ্গে মৌলিক পবর্তারোহণ প্রশিক্ষণ শেষ করে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৫ সালের মার্চ মাসে উচ্চতর পবর্তারোহণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
হিমালয়ে প্রতিবছর দুটি সময়ে পর্বতাভিযান পরিচালনা করা হয়। একটি হলো এপ্রিল-মে (প্রি মনসুন) মাসে, আরেকটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (পোস্ট মনসুন) মাসে। ২০০৭ সাল থেকে আমি প্রতিবছরই দুইবার করে হিমালয়ে যাচ্ছি পর্বতারোহণের জন্য।
পর্বতাভিযান একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি, সৎ পথে থেকে কেউ যদি কোনো ভালো কাজ করার জন্য নিবেদিত থাকে তবে অর্থ কোনো সমস্যাই নয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশের পর্বতারোহণের শুরু থেকে কোমল পানীয় মাউন্টেন ডিউ তথা ট্রান্সকম বেভারেজেস লি. সহযোগিতা করে আসছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০০৭ সালের মে মাসে নেপালের অন্নপূর্ণা হিমালয় অঞ্চলের চুলু ওয়েস্ট (২১ হাজার ৫৯ ফুট বা ছয় হাজার ৪১৯ মিটার) পর্বতশিখর এবং একই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দলনেতা হিসেবে খুম্বু হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট বা ছয় হাজার ৬৫৪ মিটার) জয় করি। ২০০৮ সালের মে-জুন মাসে অন্নপূর্ণা হিমালয় অঞ্চলের সিংগু চুলি (২১ হাজার ৩২৮ ফুট বা ছয় হাজার ৫০১ মিটার) পর্বতশৃঙ্গ জয় এবং ওই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পবর্তশৃঙ্গ মানাসলু (২৬ হাজার ৭৮০ ফুট বা আট হাজার ১৬৩ মিটার) অভিযানে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সাত হাজার মিটার (প্রায় ২৩ হাজার ফুট) উচ্চতায় উঠি। বিরূপ আবহাওয়ার জন্য অভিযান সফল হয়নি। ২০০৯ সালের মে মাসে দলনেতা হিসেবে খুম্বু হিমালয় অঞ্চলের লবুজে (২০ হাজার ৭৫ ফুট বা ছয় হাজার ১১৯ মিটার) পর্বতশৃঙ্গ এবং ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দলনেতা হিসেবে নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের ষষ্ঠ উচ্চতম পবর্তশৃঙ্গ চো ইয়ো (২৬ হাজার ৯০৬ ফুট বা আট হাজার ২০১ মিটার) জয়। চো ইয়ো পর্বতশৃঙ্গ জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ আট হাজার মিটার পর্বতারোহীদের সম্মানজনক এলিট ক্লাবে প্রবেশ করল।
গত বছর (২০১০ সালে) এপ্রিল-মে মাসে আমি এভারেস্ট অভিযানে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার জন্য অভিযান সফল হয়নি। আমার এভারেস্ট অভিযান সফল না হলেও আমি কিন্তু দমে যাইনি, হতাশ হয়ে পড়িনি। দেশে ফিরে নতুনভাবে প্রস্তুতি শুরু করি। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে হিমালয়ের একটি অবিজয়ী শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ পর্বতাভিযানে বাংলাদেশ দলের নেতা হিসেবে নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর (২০ হাজার ৫২৮ ফুট বা ছয় হাজার ২৫৭ মিটার) জয় করি।
এরপর এ বছর এপ্রিলে আবার এভারেস্ট অভিযানে বের হই। ২১ মে নর্থ ফেস (তিব্বত) দিয়ে এভারেস্ট জয় করি। এভারেস্ট চূড়ায় তুলে ধরি বাংলাদেশের পতাকা।
আমি বিশ্বাস করি, সততার সঙ্গে, ধৈর্য ধারণ করে, একাগ্রচিত্তে কাজ করলে সফলতা আসবেই। নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। পাঁচটি ছয় হাজার মিটার ও দুটি আট হাজার মিটার পর্বতশৃঙ্গ জয়ী এবং তিনটি আট হাজার মিটার পর্বতশৃঙ্গ অভিযানে অংশগ্রহণ করার কৃতিত্ব রয়েছে আমার। সাফল্যের পেছনে না ছুটে যোগ্য হতে হবে। যোগ্য হলে সফলতা একদিন ধরা দেবেই। সফলতা আসতে হবে সৎ পথে। যদিও সৎ পথ অনেক কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, কিন্তু সেই প্রাপ্তি চিরদিনের, চির অম্লান।
এম এ মুহিত: এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী।
সূত্র : স্বপ্ন নিয়ে, প্রথম আলো (৮ জুন ২০১১)
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-06-08/news/160552