খটমটে গণিত কিংবা রসহীন রসায়নের মত বিষয়গুলোকেও যদি মুহূর্তে আয়ত্তে নিয়ে আসার মন্ত্র থাকতো তবে কতই না ভাল হত। এমন ভাবনা পরীক্ষার আগের রাতে মনে ঘুরপাক খায়নি এমন শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। বিশেষ কোন মন্ত্র না হলেও চমত্কার সব ভিডিওর মাধ্যমে পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কিন্তু দিচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন স্কুল ‘রবি-টেন মিনিট স্কুল’। বিশেষ ধরনের এ স্কুল গড়ে তোলার পেছনে কাজ করেছেন আয়মান সাদিক। সম্প্রতি এ তরুণের অর্জনের ঝুলিতে উঠে এসেছে সম্মানজনক কুইন্স ইয়াং লিডার অ্যাওয়ার্ড।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- ছোট্টবেলায় আমরা সবাই ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়।’ এটা আসলে খুব সত্য। তবে এটাও সত্য ইচ্ছা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। লেগে থাকার মানসিকতাও থাকতে হবে। কারণ, পদে পদে প্রতিবন্ধকতা আসাটা খুব স্বাভাবিক। একবার হোঁচট খেয়েই থেমে গেলে হবে না। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে শুরু করার মতো সৎসাহস থাকতে হবে।
তার পুরো সাক্ষাৎকারটি ক্যারিয়ার ইনটেলিজেন্সের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
টেন মিনিট স্কুল নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলুন।
টেন মিনিট স্কুল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষামূলক প্লাটফর্ম। প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী এখান থেকে শিক্ষা-সংক্রান্ত নানা সহায়তা নিয়ে থাকে।
শুধু ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে এর শুরুটা হলেও এখন প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সব বিষয়ের, সব টপিকের ওপর ভিডিও কন্টেন্ট, কুইজ, লাইভ ক্লাস, স্মার্ট বুক আছে। এছাড়া স্কিল ডেভেলপমেন্ট আর প্রফেশনাল কোর্স নামে আমাদের আরো দুটো সেকশন আছে, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা ডিবেট, মডেল ইউনাইটেড নেশনসের মতো বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম, মাইক্রোসফট অফিস আর অ্যাডবির প্রতিটি সফটওয়্যার, প্রেজেন্টেশন আর ইন্টারভিউর মতো সফট স্কিলস, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, পার্সোনাল লিডারশিপের মতো প্রফেশনাল স্কিলসের ওপরে যখন ইচ্ছা কোর্স করে নিতে পারবে, একেবারে বিনামূল্যে।
টেন মিনিট স্কুল ব্লগে মিলবে দারুণ সব বিষয় নিয়ে চমত্কার কিছু লেখা। এছাড়া ‘সারপ্রাইজ মি’ এবং ‘ইন্টার-অ্যাক্টিভ ভিডিও’ সেকশনে রয়েছে দারুণ সব কুইজ আর ভিডিও। শিগগিরই আমরা আমাদের অ্যাপটা লঞ্চ করতে যাচ্ছি, যেখানে ওয়েবসাইটের সব কনটেন্টের পাশাপাশি থাকবে দারুণ সব ফিচার।
আমাদের ‘টেন মিনিট স্কুল লাইভ’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে বর্তমান সদস্য সংখ্যা নয় লাখের বেশি! এটা ছাড়াও আরো চারটি ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের চাহিদামতো শিক্ষামূলক কনটেন্ট দেয়া হয়।
এমন নামকরণের কারণ?
আমরা বাঙালিরা সাধারণত ১০ মিনিটকে সময় হিসেবে বেশ পছন্দ করি কিংবা প্রাধান্য দিয়ে থাকি! এই যেমন ধরা যাক, আমার কোনো একটা কাজে কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বের হওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেল সময়মতো বের না হওয়ার কারণে সে আমাকে ফোন করে বসলে বাসা থেকে বের না হয়েও অনেক সময় বলে ফেলি ১০ মিনিটে আসছি। কিংবা কেউ কোনো কাজ করে দিতে বললে সাধারণত বলি যে ১০ মিনিটে করে দিচ্ছি! আসলে ১০ মিনিট লাগুক আর না লাগুক ১০ মিনিট বলতে আমরা বেশ ভালোবাসি। মূলত সেখান থেকেই নাম হিসেবে টেন মিনিট স্কুল দেয়ার বিষয়টা মাথায় আসে।
কীভাবে শুরু?
এ আইডিয়াটা প্রথমবারের মতো মাথায় আসে আইবিএতে ক্লাস শুরু করার পরপরই। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম, স্বভাবতই হিসাববিজ্ঞান নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না। ক্লাসে টিচারের বলা কোনো কথাই মাথায় ঢুকছিল না। তখন সাহায্য নিলাম ইউটিউবের। আমার হিসাববিজ্ঞান নিয়ে যে কোর্সটা ছিল, সেটার সবগুলো টপিক ১৫ মিনিটের টিউটোরিয়াল আকারে দেয়া ছিল সেখানে। সেই কোর্সে বেশ ভালো স্কোর আসে আমার। তখনই ভাবলাম যদি বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এমন কিছু থাকত, তবে কতই না ভালো হতো।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভৌগোলিক অবস্থান একটা বিশাল প্রতিবন্ধকতা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ থেকেই আমি কোচিংয়ে পড়াতাম। তখন প্রায়ই আমার কাছে এমন কিছু ছাত্রছাত্রী অনুরোধ নিয়ে আসত, যাদেরকে তাদের মা-বাবা হয়তো কোচিংয়ে ভর্তির নির্ধারিত ফীর পুরো টাকাটাও সঙ্গে দিয়ে দিতে পারেননি। আমি বললে হয়তো কোচিং ওদেরকে ভর্তি করে নেবে কিন্তু তারপর কী হবে। সে থাকবেই বা কোথায়; খাবে কী? আমি এমনও অনেককে দেখেছি, যে কিনা কোচিং শেষ করে সেখানেই বেঞ্চ সরিয়ে রাত্রিযাপন করত। এ জিনিসগুলো আমাকে বেশ ভাবাত। খুব খারাপ লাগত। মনে হতো, যদি পারতাম এ ছেলেমেয়েগুলোকে সাহায্য করতে। তখনই ভাবলাম যে আমি যেগুলো পড়াই, সে ক্লাসগুলোকেই রেকর্ড করে ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া গেলে তো সেটাকে সবাই কাজে লাগাতে পারবে। তো সেখান থেকেই শুরু।
টেন মিনিট স্কুল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সব ভিডিওসহ, সব ব্লগ, কুইজ, লাইভ ক্লাস, টিউটোরিয়াল, স্মার্টবুকসহ টেন মিনিট স্কুলের সব কনটেন্ট আর দারুণ সব ফিচার নিয়ে একটি অ্যাপ আসছে শিগগিরই। আর আমাদের ওয়েবসাইটেও এরই মাঝে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সব কন্টেন্ট চলে এসেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য ইউনিভার্সিটি কোর্সগুলো নিয়ে কাজ করা। আমাদের অ্যাপটা চলে আসার পরপর এ বছরই ‘টেন মিনিট স্কুল গ্লোবাল’ নামে একটা আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম শুরুর পরিকল্পনা আছে, যেখান থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরাও বিনামূল্যে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন শিক্ষামূলক কনটেন্ট পাবে।
তাছাড়া টেন মিনিট স্কুলের একটা বড় স্বপ্ন, আগামীতে বাংলাদেশের সবাই বিনামূল্যে যে কোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় গুণগত শিক্ষা পাবে। দেশের ৪ কোটি ২৭ লাখ নিবন্ধিত শিক্ষার্থী এবং ১ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি টেন মিনিট স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের সব স্থানের শিক্ষার্থীরা যেন যেকোনো মুহূর্তে সব ধরনের শিক্ষামূলক কনটেন্ট ও সহায়তা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিজেদের হাতের কাছে পেতে পারে, সেটা সুনিশ্চিত হয়।
২০১৮ সালের কুইন্স ইয়ং লিডার অ্যাওয়ার্ড আপনার অর্জনের ঝুলিতে। সেটা নিয়ে কিছু বলুন।
পুরস্কার বিষয়টা যে কারো জন্যই আনন্দের, সম্মানের, গৌরবের। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। আর যখন সেটা হয় আন্তর্জাতিক, তাহলে তো সেটার অনুভূতিটা প্রকাশের ঊর্ধ্বে। আর এটা কেবল আমার জন্যই নয় পুরো টেন মিনিট স্কুল পরিবার এবং সারা বাংলাদেশের জন্যই অত্যন্ত অনুপ্রেরণার। যখন আমাদের নিজস্ব কোনো অবদানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি মেলে, তখন মনে হয় যে বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপন করার মতো একটা প্লাটফর্ম আমরা তৈরি করতে পেরেছি, যেটা আমাদেরকে অনেকটা সাহস দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়।
বাংলাদেশ থেকে করা ফোর্বসের ‘৩০ আন্ডার ৩০’-এ জায়গা করে নিয়েছেন। এমন প্রাপ্তি নিয়ে জানতে চাই।
ফোর্বসের মতো একটা সাময়িকীর করা কোনো তালিকায় জায়গা করে নেয়াটা নিঃসন্দেহে একটি মর্যাদাপূর্ণ অর্জন। এটার পেছনে অবদান রেখেছে মূলত বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি আনা। টেন মিনিট স্কুলে প্রতিদিন ২ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, যেটা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি অনুসরণ করার মতো উদাহরণ। আমাদের এ অবদানকে যখন ফোর্বসের মতো একটা আন্তর্জাতিক সাময়িকী স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন সেটা অবশ্যই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হয়ে থাকবে।
ব্যক্তি আয়মান সাদিক কেমন? তার শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনতে চাই।
ব্যক্তি আয়মান সাদিক খুবই সাধারণ। ছোটবেলার সেসব গল্প আসলে বলে শেষ করা কঠিন। তবু অনেক ঘটনা মনে হলে এখনো হাসি পায়। তেমন একটা ঘটনা হচ্ছে— ছোট্ট বেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে ছিলো হরলিকসের বয়াম থেকে শুকনো হরলিকস চুরি করে খাওয়া। একবার মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর শাস্তি হিসেবে পুরো এক বয়াম হরলিকস খেয়ে শেষ করতে হয়েছিল আমাকে!
যে স্বপ্ন এখনো দেখেন—
কিছুদিন আগে একবার টেন মিনিট স্কুলের সেশন নিতে সিলেট গিয়েছিলাম। সেখানে আমার শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়। তো কথায় কথায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসঙ্গটা উঠল। স্যারের মতে, আমরা অনেক বেশি মুখস্থ আর সাজেশননির্ভর হয়ে যাচ্ছি। আর সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোয় এখনকার শিশুদের তেমন আগ্রহ নেই। অথচ লেখাপড়ার পাশাপাশি এসবেরও কিন্তু অনেক গুরুত্ব রয়েছে, যেটা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে একজন শিক্ষার্থী ভালোভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকে না।
আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে সবাই লেখাপড়া করবে আনন্দ নিয়ে। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হবে শিখে, জেনে আর বুঝে সেটাকে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করা। আর সবাই শিখবে হাতে-কলমে। কেউ আর মুখস্থ কিংবা সাজেশনের ওপর নির্ভর করবে না। লেখাপড়ার পাশাপাশি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমগুলোও সমানভাবে প্রাধান্য পাবে। বদলে যাবে পাঠ্যক্রম। সামঞ্জস্য রাখা হবে কর্মক্ষেত্রে দাবিকৃত দক্ষতার সঙ্গে পাঠ্যক্রমের।
আপনার মতে তরুণরা কী চাইলেই পারে?
ছোট্টবেলায় আমরা সবাই ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়।’ এটা আসলে খুব সত্য। তবে এটাও সত্য ইচ্ছা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। লেগে থাকার মানসিকতাও থাকতে হবে। কারণ, পদে পদে প্রতিবন্ধকতা আসাটা খুব স্বাভাবিক। একবার হোঁচট খেয়েই থেমে গেলে হবে না। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে শুরু করার মতো সৎসাহস থাকতে হবে। স্বপ্ন দেখতে সবাই পারে। কিন্তু সেটাকে সত্যি করতে এর পেছনে প্রয়োজনীয় শ্রম আর প্রচেষ্টা দিয়ে লেগে থাকতে হবে। পরিশ্রম করলে সফলতা আসাটা সময়ের ব্যাপার।
বনিক বার্তা