সৈয়দ আখতারুজ্জামান
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রিজ ইনস্টিউট অব ট্রেনিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি
ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও প্রশিক্ষক
খুব চাপে আছেন বলে মনে হচ্ছে। আবার উল্টোটাও তো হচ্ছে- অনেক কাজের চাপ নিয়েও দিব্যি হেসেখেলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কাজের সময় ঠিকঠাক নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজটা করে বাসায় গিয়ে সিনেমা দেখতে বসে গেলেন, পরিবার নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে গেলেন! তার মানে, কাজের চাপ সামলাতে কাজ নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। আসুন, আমরা আমাদের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা সামলাতে কিছু সহজ উপায় জেনে নিই
এক
আসলেই কাজের চাপে আছেন নাকি শুধু শুধু ঘাবড়ে যাচ্ছেন, বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। মনে মনে ভাবছেন, যদি কাজটা ঠিকমতো না হয়! যদি ভুল হয়! যদি সব গুবলেট পাকিয়ে যায়! সুতরাং কেন চাপ মনে করছেন সেটা আরেকবার যাচাই করুন।
দুই
চাপের ধরন চিহ্নিত করুন। নানা কারণে কর্মক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মিলিয়ে এই কারণগুলোকে মূলত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। ক. কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ (শব্দদূষণ, ঠাসাঠাসি), খ. কাজের ধরন (খুব কম সময়ে শেষ করতে হয়, ভুল হলো কি না সেটা দ্বিতীয়বার দেখার কোনো সুযোগ নেই), গ. কাজের সংস্কৃতি (ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক, অফিস পলিটিকস), ঘ. নিজের শারীরিক অবস্থা, ঙ. নিজের আচরণগত বিষয় (সহকর্মীদের সঙ্গে আপনার আচরণ কিংবা সহকর্মীর আচরণে আপনার প্রতিক্রিয়া), চ. নিজের দক্ষতা (কাজটা কত ভালো করতে পারছেন অথবা বুঝতে পারছেন কি না), ছ. নিজের মানসিকতা (অন্যের সাহায্য নিতে না চাওয়া, কে কী মনে করল সেটা নিয়ে খুব চাপে থাকা)। এবার সিদ্ধান্ত নিন আপনি কেন চাপে আছেন।
তিন
আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে দোষে-গুণে প্রত্যেকের চেয়ে আলাদা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা ক. কাজের ব্যাপারে বেশি মাত্রায় খুঁতখুঁতে, খ. শেষ মুহূর্তে কাজ শুরু করেন, গ. আত্মশ্লাঘায় ভোগেন (ইগোইজম), ঘ. নিজেকে প্রতিযোগিতায় ফেলে কাজ করেন, ঙ. উচ্চাকাঙ্ক্ষা যাঁর বেশি, চ. আত্মসম্মানবোধ প্রচণ্ড, ছ. সব কাজ নিজের কাজ মনে করেন। এ ছাড়া এসংক্রান্ত আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করেন, তাঁরা সাধারণত কাজের চাপে ভোগেন বেশি। জানা দরকার, আপনি এসবের কোন কারণে চাপে আছেন।
এবার আসুন সমাধানের আরো সহজ জায়গাগুলো দেখি।
চার
কাজের চাপকে সহজভাবে গ্রহণ করুন। চাপ কমানো এক দিনের অনুশীলন নয়।
পাঁচ
মানসিক অবস্থা বদলাতে হবে -কাজের চরিত্র নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, পারিপার্শ্বিক অবস্থাও।
ছয়
জীবনে শৃঙ্খলা আনুন। ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, সময়মতো খাওয়াদাওয়া করা, সময়মতো ঘুমানো, ইত্যাদি। সারা দিন অফিস করে অনেক রাতে ঘরে ফিরে রাত ৩টা পর্যন্ত সিনেমা দেখলে তার পরের দিন তো শরীর খারাপ লাগবেই। কাজের চাপ এই ছোট ছোট কারণের সম্মিলনমাত্র।
সাত
সময়ের যথাযথ ব্যবহার করুন। এক ঢিলে দুই/তিন/চার পাখি মারতে হবে। সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সময়কে ব্যবহার করতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা জানতে হবে।
আট
‘হ্যাঁ’কে হ্যাঁ আর ‘না’কে না বলতে শিখুন। অনেক সময়ই ‘না’ বলা উচিত অথচ ‘হ্যাঁ’ বলে ফেঁসে যাই।
নয়
অনেকেই অন্যের কাজ আপনার ওপর চাপাতে চাইবে। সেটা যেমন ঠিক নয়, আপনারও উচিত নয় নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপানো।
দশ
সহকর্মীদের চিনুন। কে কোন কাজ ভালোবাসে, কে কোন কাজে পারদর্শী, কে আপনার প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়াবে, কে হাত বাড়ালেও কাজটা আসলে ভালো বোঝে না ইত্যাদি বিষয় জানা থাকলে কাজের চাপে এরা আপনার চাপ কমাতে সাহায্য করলেও করতে পারে।
এগারো
সময় অপচয়কারী ব্যক্তি বা বিষয়গুলো চিহ্নিত করুন। অপ্রয়োজনীয় ফোন, হঠাৎ বন্ধুর আগমন -এ রকম আরো যা যা আছে।
বারো
কাজের শেষে স্বামী/স্ত্রী, ছেলেমেয়ে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। মানসিক অবস্থা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
তেরো
অবসরে পরিবার নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ কাজের চাপ আরো বাড়িয়ে তোলে। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য এমন অবসর কাটানোর আসলেই সহজ কোনো বিকল্প নেই।
চৌদ্দ
যা যা আপনার শখের সেই কাজগুলো আবার জীবনে ফিরিয়ে আনুন। কে বলেছে স্ট্যাম্প জমানো শুধু শিশুদের শখ? ফটোগ্রাফি? শুধু ফেসবুক কেন?
পনেরো
শরীরচর্চা করুন। মন ভালো রাখতে সুস্বাস্থ্য অনেক জরুরি।
ষোলো
ভালো ঘুম অনিবার্য। ভালো ঘুম না হলে সব কাজেই এর প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে মনোযোগে, ব্যবহারে সর্বত্র।
সতেরো
ধূমপান কাজের চাপ সামলাতে সাহায্য করে-এটি ভুল ধারণা। বরং উল্টোটাই সত্য। সাময়িক আরাম বড় সমস্যা ডেকে আনে, কাজের চাপ সামলায় না আসলে। শাকসবজি, বেশি পরিমাণে পানি খাওয়া, ফলমূল ইত্যাদি আপনাকে সতেজ রাখবে।
আঠারো
ডেস্ক সব সময় গুছিয়ে রাখুন। প্রিয় মানুষের ছবি, ছোটখাটো প্লান্ট, শোপিস ইত্যাদি সাজিয়ে রাখুন; ভালো লাগবে।
উনিশ
খুব কাজের চাপ মনে হলে সব ভুলে গিয়ে পাঁচ মিনিট চুপচাপ গান শুনুন। আবার কাজে ফিরে আসুন। ভালো লাগবে।
বিশ
অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় গুছিয়ে রাখুন। সময়মতো প্রয়োজনীয় নথিপত্র হাতের কাছে না পেলে সহজ কাজও কঠিন হয়ে যায়।
সৌজন্যে : এ টু জেড, কালের কণ্ঠ (৩০ এপ্রিল ২০১২, সোমবার)