হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। তিনি একাধারে নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রনির্মাতা। তাঁর প্রকাশিক গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৫ সাল—একটা স্যুটকেস এবং ‘হোল্ডঅল’ নামক বস্তুতে লেপ-তোশক ভরে ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমাকে সিট দেওয়া হবে। একটু ভয় ভয় লাগছে। সুপারের রুমে ডাক পড়ল। সুপার একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ২০৬ নম্বর রুম। জানালার কাছের সিট। আমি ৪৮ টাকা দিয়ে ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম। আতঙ্কে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে জেলখানা। এর আগে কখনো বাবা, মা, ভাইবোন ছেড়ে এত দূরে থাকিনি।
মুশকিল হচ্ছে, ঢাকায় তখন আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। অর্ধেক দামে সিনেমার টিকিট কেনার মতো পয়সাও নেই। সময় কাটানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম। সকালবেলা বেরিয়ে পড়ি। দুপুরের আগে হোস্টেলে ফিরে ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ফিরি সন্ধ্যা মেলানোর পর।
এ রকম ঘুরতে ঘুরতেই মুখলেসুর রহমান নামের একজনের দেখা পেলাম। তার পেশা অদ্ভুত। ম্যাজিক দেখায় এবং টাকার বিনিময়ে ম্যাজিকের কৌশল বলে দেয়। ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। অপূর্ব সব ম্যাজিক। তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই সে দেখাচ্ছে চারটা টেক্কা। নিমিষেই চার টেক্কা হয়ে গেল চার বিবি। এখানেই শেষ নয়—ফুঁ দেওয়া মাত্র চার বিবিও অদৃশ্য। বিবির জায়গায় সাদা তাস। মুখলেসুর রহমান তাস চারটা পকেটে রেখে বিড়ি ধরিয়ে বলল, কেউ যদি এই তাস কিনতে চান—পাঁচ টাকা, মাত্র পাঁচ টাকা। আর যদি শুধু কৌশল জানতে চান, তিন টাকা। তিন টাকা। তিন টাকা।
আমার কৌতূহল প্রবল, আমার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। তিন টাকা দিয়ে কৌশল জানলাম। তবে কৌশল বলার আগে আমাকে তিন পীরের, মা-বাবার এবং ভাতের কসম কাটতে হলো—এই কৌশল কাউকে বলা যাবে না।
ছুটির দিন হলেই আমি খুঁজে খুঁজে মুখলেসুর রহমানকে বের করি। সে সাধারণত বসে গুলিস্তান এলাকায়। মাঝে মাঝে ফার্মগেটের কাছে। পরের বার তার কাছ থেকে শিখলাম দড়ি কাটার কৌশল। দড়ি কেটে দুখণ্ড করা হয়। নিমিষের মধ্যে সেই দড়ি জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। কৌশল এত সহজ কিন্তু করা হয় অতি নিপুণ ভঙ্গিতে। দড়ি কাটার কৌশল শিখতে আমার পাঁচ টাকা চলে গেল। শিখলাম পয়সা তৈরির কৌশল। চার আনা, আট আনার মুদ্রা বাতাস থেকে তৈরি করে ঝনঝন করে টিনের কৌটায় ফেলা হয়। এই কৌশল শিখতে ১০ টাকা চলে গেল।
হোস্টেলে থাকার জন্য বাসা থেকে সামান্যই টাকা পাই। সেই সামান্য টাকার বড় অংশ চলে যাচ্ছে ম্যাজিকে। আমাকে মিথ্যা করে চিঠি লিখতে হয় ‘বই কিনতে হবে, টাকা দরকার। কলম হারিয়ে গেছে, নতুন কলম দরকার।’
দুবছর পর আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরোলাম। বন্ধুমহলে আমি তখন ‘ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন’ বলে পরিচিত। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ম্যাজিকের ভূত আমাকে ছাড়ল না। আমি তখন সিন্দাবাদ। মাজিকের ভূত আমার ঘাড়ে বসে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এক প্রতিভা প্রদর্শনীর আয়োজন হলো। গান-নাচ-আবৃত্তি যে যা জানে। টিএসসিতে বিশাল ব্যবস্থা। আমিও উপস্থিত হলাম আমার ‘ম্যাজিক প্রতিভা’ নিয়ে। হলভর্তি ছাত্র-শিক্ষক। বিরাট মঞ্চ। চোখ ধাঁধানো আলো। ভয়ে আমার পা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। জিভ সিসার মতো ভারী হয়ে গেছে। শুধু তা-ই না, সাইজও মনে হয় খানিকটা বড় হয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে প্রথম আইটেম দেখালাম। ট্রায়াঙ্গুলার বাক্স থেকে কবুতর ও মুরগি বের করার খেলা। এই বাক্স আমার নিজের না—অন্য এক জাদুকরের কাছ থেকে ২০ টাকায় ভাড়া করে এনেছি। প্রথম খেলাটা খুব জমে গেল। প্রচণ্ড হাততালি। আমার আড়ষ্টতা কেটে গেল। দ্বিতীয় আইটেম ‘অ্যান্টি গ্রেভিটি বটল’। একটা বোতল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে শূন্যে ভাসবে। এটিও জমে গেল। আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল—আমার সামান্য ম্যাজিকে যে কারণে তাদের উল্লাসের সীমা রইল না। সেদিন ‘খেলা’ ভালোই দেখিয়েছিলাম। কারণ, এক সপ্তাহ না যেতেই টিভিতে ডাক পেলাম। তারা একটা প্রোগ্রাম করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে অনুষ্ঠান, যেখানে আমার জন্য পাঁচ মিনিট বরাদ্দ করা আছে। মিনিটে ১০ টাকা হিসেবে আমি পাব ৫০ টাকা। আমার আনন্দ ও বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঠিক করলাম মুদ্রা তৈরির খেলা দেখাব। শূন্য থেকে মুদ্রা তৈরি করে টিনের কৌটায় ফেলা। ঝনঝন শব্দ হতে থাকবে—একসময় কৌটা মুদ্রায় ভর্তি হয়ে যাবে।
যথাসময়ে টিভি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। তখন টিভি ছিল ডিআইটি ভবনে। সব প্রোগ্রাম হতো লাইভ। আমার নিজের অনুষ্ঠান নিজে দেখতে পেলাম না। তাতে আমার আনন্দের কমতি হলো না। স্টুডিও থেকে বের হয়ে মনে হলো, সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে লাগল তরুণ জাদুকরকে।
আমার কোনো নেশা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না—এটা হয়ে গেল। মানুষকে বিস্মিত করতে পারার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে বুঁদ হয়ে রইলাম। কেমিস্ট্রি পড়া চালিয়ে যাচ্ছি—চালাতে হয় বলেই চালানো। ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা প্রায়ই খবর দেন—হুমায়ূন, বাসায় একটা জন্মদিনের পার্টি আছে, ম্যাজিক দেখিয়ে যাও। আমি মহা-উৎসাহে রিকশায় করে বাক্সটাক্স নিয়ে রওনা হই। একদিন ঢাকা জুট মিলে ম্যাজিক দেখিয়ে দু শ টাকা পেলাম। এক শ চলে গেল যন্ত্রপাতির ভাড়ায়। এক শ লাভ। আমার একটাই স্বপ্ন—‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যজিশিয়ানস’-এর সদস্য হবো। নেশা লেগে গেল।
এখন বলি নেশা কী করে কাটল সেই গল্প। নেশা পুরোপুরি কেটে গেল আমার বাসররাতে। বালিকাবধূকে মুগ্ধ করার জন্য রাত তিনটার দিকে তাকে ম্যাজিক দেখাতে শুরু কললাম। হয়তো খুব সাবধান ছিলাম না কিংবা নবপরিণীতা স্ত্রীর সামনে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম—দড়ি কাটার খেলাটা সে ধরে ফেলল এবং খুব খুব হাসতে লাগল। দ্বিতীয় খেলাটায়ও একই অবস্থা। ওই রাতেই আমার শেষ ম্যাজিক শো হলো। আর কখনো ম্যাজিক দেখাইনি বা দেখাতে উৎসাহ বোধ করিনি।
বিয়ের পর ১৫ বছর হয়েছে। ১৫ বছরে কোনো ম্যাজিক দেখাইনি। তার পরেও ‘কিম আশ্চর্যম’! হঠাৎ ইংল্যান্ড থেকে চিঠি এসে উপস্থিত—আমাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যজিশিয়ানস’-এর সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। এই অতি আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হয়েছে আমার জাদুকর বন্ধু জুয়েল আইচের কারণে। এই ভালো মানুষটি আমাকে বিস্মিত করার সুন্দর ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যজিশিয়ানস’-এর চিঠিটা এসে পৌঁছাল আমার জন্মদিনে। কাকতালীয় ব্যাপার তো বটেই। মাঝ মাঝে কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে বলেই আমাদের এই জীবন এবং এই পৃথিবী এত মজার। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: আমার আপন আঁধার, আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪