‘নুন আন্তে পান্তা ফুরায়’-উত্তর গুজরাটের এমন এক কৃষক পরিবারে জন্ম। রসায়ন বিভাগ থেকে ২১ বছর বয়সে বিএসসি পাশ করে একজন সাধারণ ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে শুরু করেন জীবন। কিন্ত যে মানুষটির নাম কোটি কোটি মানুষের গৃহে ছড়িয়ে পড়বে -উনি একটি সাধারণ ল্যাবে বন্দী হয়ে থাকবেন কেন?
তাছাড়া, বেতনের টাকা-আসতে সময় লাগে ৩০ দিন আর খরচ হতে সময় লাগে বড়জোড় তিন দিন। নতুন কিছু করার চিন্তা থেকেই নিজের বাড়ির পেছনে শুরু করলেন-কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট তৈরি।
উনার খামখেয়ালী কাণ্ড দেখে প্রতিবেশীরা শুরু করলো হাসাহাসি। বাজারে তখন সার্ফের একচেটিয়া দাপট। এ যেন কুমিরের সাথে শোল মাছের যুদ্ধ। মানুষ হাসবে না তো কি করবে?
মানুষের হাসি তামাশা যত বাড়লো- উনার উদ্দীপনা তার চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকলো। সারাদিন অফিসে কাজ শেষ করে সারারাত ভর শুরু হলো হার না মানা পরিশ্রম। একজন ব্যক্তি, একাই কাজ, একাই মালিক, একাই শ্রমিক, একাই বিক্রেতা, বলতে গেলে-ওয়ান ম্যান কোম্পানী।
অফিসে যাওয়ার পথে সাইকেলে করে ডিটারজেন্ট প্যাকেটগুলো নিয়ে যান। খুবই সস্তা দামে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। কাজ থেকে ফিরে পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝান। কেউ কিনে কেউ ধমক দিয়ে, কেউ বা গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তিনি অদম্য। তার তৈরি জিনিসটি ভালো। দামে সস্তা। এককেজি পাওডারের দাম মাত্র সাড়ে তিন রুপি। সেখানে সার্ফের দাম প্রায় ১৬ রুপি। জিনিসটি মানুষ কিনবে না কেন?
অবশেষে আসলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের কোনো একদিন। সারাদিন ছুটি। অফিস নেই। সকালে কাকডাকা ভোরে বের হয়ে রাতে বাসায় ফিরলেন। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিক্রি করলেন মাত্র ১৬ প্যাকেট পাউডার। আর এতেই ভদ্রলোক যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দ পেলেন।
এরপর থেকে ইতিহাস। প্রতিদিন বাড়তে থাকলো বিক্রি। সেদিনের ১৬ প্যাকেট আজ দিনেই বিক্রি হয় প্রায় লাখো প্যাকেট। ১০০ স্কয়ার ফিটের যে ঘরে সারারাত জেগে পাওডার তৈরি করতেন সেই ১০০ স্কয়ার ফিটের আধিপত্য আজ শুধু ভারতবর্ষই নয়-ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এযেন এক রুপকথার মতো গল্প।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল কারসানভাই প্যাটেলের মেয়ে নিরমা। মেয়েকে অমর করে রাখতে নিজের ব্র্যান্ডের নামও নিরমা রেখে দেন আহমেদাবাদের ওই ব্যক্তি। যে ব্র্যান্ডটি তার কাছে মেয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আজ সেই ব্র্যান্ডের সঙ্গে কারসানভাইয়ের মেয়ের নামও ঘোরে সবার মুখে মুখে। ‘সব কী পসন্দ নিরমা’। দরজায় দরজায় ডিটারজেন্ট বিক্রি করা নিরমার বাবা আজ ডিটারজেন্টের বাজারে পঁয়ত্রিশ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
১৯৬৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে নিরমার যাত্রা। সেই সময়টায় দেশীয় ডিটারজেন্টের কোম্পানির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে প্রথমের দিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল কারসানভাইকে। তবে, বিজনেস স্ট্র্যাটেজিতে নতুন চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করে সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি। গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বাজার ধরতে প্রথমে তিনি শুরু করলেন সস্তায় ডিটারজেন্ট বিক্রি। খোকরায় নিজের বাড়ির পিছনে বসে নিজেই শুরু করলেন ডিটারজেন্ট তৈরি করা। তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৩ টাকা কেজি দরে তা বিক্রি করতেন কারসানভাই। সেই সময় অন্যান্য ডিটারজেন্টের দাম ছিল কেজি প্রতি ১৩-১৪ টাকা।
৮০-র দশকে বিজ্ঞাপনী প্রচারে আলোড়ন ফেলে দেন কারসানভাই। মেয়ে নিরমার সাদা ফ্রক পরা একটি ছবিকে কেন্দ্র করে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ‘সব কী পসন্দ নিরমা’। নিরমার জিঙ্গল বিক্রি বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় এই ডিটারজেন্টের। তাদের সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সার্ফও তাদের থেকে বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে পড়ে।
শুধু ডিটারজেন্টই নয়, নিজের ব্যবসাকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন কারসানভাই। লাজুক স্বভাবের এই মানুষটি ১৯৯৫ সালে তৈরি করেন নিরমা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ২০০৩ সালে তৈরি করেন নিরমা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ২০০৪ সালে কারসানভাই চালু করেন নিরমাল্যাবস এডুকেশন প্রজেক্ট।
সাইকেলে ক্রিং ক্রিং করে ডোর টু ডোর ডিটারজেন্ট বিক্রি করা কারসানভাই আজ ২৫০০ কোটির মালিক। ২০১০ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে ভারত সরকার।