মাছ প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাছ চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন-একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়, খাল ও ডোবায় মাছ চাষ করা যায়, আবার চৌবাচ্চায়ও মাছের চাষ করা যায়।
সাধারণত পুকুরে খাবার উৎপাদনই হচ্ছে মাছ চাষ। এটি কৃষির মতই একটি চাষাবাদ পদ্ধতি। আবার কোনো নির্দিষ্ট জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প পুঁজি, অল্প সময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের উৎপাদনকে মাছ চাষ বলে। মূলত বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদনকেই মাছ চাষ বলা হয়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- মো: সিফাতুল্লাহ।
চাষ উপযোগী মাছের গুণাগুণ ও উপকারিতা
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। এছাড়া খাড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতে কয়েকশ’ প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছগুলো হলো- রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, বিদেশী মাগুর, থাই পাঙ্গাস প্রভৃতি। এসব মাছের কিছু গুণ আছে। যেমন-
১. এসব মাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
২. খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না।
৩. পুকুরে বেশি সংখ্যায় চাষ করা যায়।
৪. পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে, তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে।
৫. এসব মাছ খেতে বেশ সুস্বাদু।
৬. বাজারে এসব মাছের প্রচুর চাহিদা আছে।
৭. সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
বাজার সম্ভাবনা
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মাছ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর অনেক চাহিদা থাকার কারণে মাছ চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। স্থানীয় হাট, বাজার ছাড়াও দূরবর্তী বাজারে মাছ বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া বিদেশে মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের চিংড়িকে সাদা সোনা বলা হয়। কারণ এ চিংড়ি রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যায়।
উৎপাদন কৌশল
পুকুরে মাছ চাষ
নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে পুকুরে মাছ চাষ করা যায়-
১. সনাতন পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে পুকুরের কোনো ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয় মাছ তা খেয়ে জীবন ধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো পরিচর্যা করতে হয় না।
২. আধা-নিবিড় পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাবার উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের দিকে লক্ষ রেখে মাছের পোনা ছাড়তে হয়।
৩. নিবিড় পদ্ধতি : অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সার ব্যবহার করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
৪. কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ : পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বিগহেড, সিলভারকার্প, কমনকার্প প্রভৃতি নানা প্রজাতির মাছ একত্রে চাষ করা যায়।
মাছ চাষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
পুকুর নির্বাচন
১. পুকুরটি খোলামেলা জায়গায় এবং বাড়ির আশেপাশে হতে হবে।
২. মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো।
৩. পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০ শতাংশ থেকে ১ একর আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
৪. পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে।
৫. পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপ-ঝাড় রাখা যাবে না।
পুকুর প্রস্তুত
পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। সাধারণত পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেয়া হয়। পুকুর প্রস্তুতির কাজটি পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপে করতে হবে-
১ম ধাপ
জলজ আগাছা যেমন-কচুরিপানা, কলমি লতা, হেলেঞ্চা ইত্যাদি শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে।
২য় ধাপ
শোল, গজার, বোয়াল, টাকি ইত্যাদি রাক্ষুসে মাছ এবং অবাঞ্ছিত মাছ যেমন- মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩য় ধাপ
এরপর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠাণ্ডা করে পুকুরের সব জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হবে।
৪র্থ ধাপ
মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে চুন দেয়ার এক সপ্তাহ পর জৈব সার দিতে হবে।
৫ম ধাপ
পুকুর শুকনা হলে পুকুরে সার, চুন, গোবর সার ছিটিয়ে দিয়ে লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে পানি ঢোকাতে হবে।
৬ষ্ঠ ধাপ
পোনা মজুদের আগে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে।
৭ম ধাপ
পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুদ করতে হবে। মৃত্যুর হার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সে:মি: হতে হবে।
৮ম ধাপ
এর পর নিয়মমত পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-
১. পোনা হাড়িতে বা পলিথিন ব্যাগে আনা হলে, পলিথিন ব্যাগটির মুখ খোলার আগে পুকুরের পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
২. তারপর ব্যাগের মুখ খুলে অল্প করে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে ভরতে হবে।
৩. ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা যখন সমান হবে তখন পাত্র বা ব্যাগের মুখ আধা পানিতে ডুবিয়ে কাত করে সমস্ত পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। সকাল ও বিকেলই পোনা ছাড়ার ভালো সময়।
৯ম ধাপ
দিনে দুইবার অর্থাৎ সকাল ১০টায় এবং বিকাল ৩টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসি ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
সতর্কতা
১. রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে।
২. সঠিক সংখ্যায় পোনা মজুদ করতে হবে।
৩. পোনা ছাড়ার আগে রোগমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
৪. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুকুরে যাতে আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫. প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।
মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ
১. মাছ প্রক্রিয়াজাতের সময় হাত দিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা যাবে না।
২. মাছ ধরার পর মাছের আকৃতি অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে।
৩. বাক্সে বা পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে মাছ সাজাতে হবে।
পরিচর্যা
১. বর্ষার শেষে পুকুরের পানিতে লাল বা সবুজ সর পরলে তা তুলে ফেলতে হবে।
২. পানির সবুজভাব কমে গেলে অবশ্যই পরিমাণমত সার দিতে হবে।
৩. মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের অবস্থা দেখতে হবে।
৪. পুকুরে জাল টেনে মাছের ব্যায়াম করাতে হবে।
মাছের সংরক্ষণ
তাজাভাবে মাছ সংরক্ষণের জন্য নিচের কৌশলগুলো অনুসরণ করা যায় :
১. শুকনোভাবে অথবা ভেজা অবস্থায় লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা যায়।
২. মাছ কেটে নাড়ি ভুড়ি, মাথা ইত্যাদি ফেলে দিয়ে চাক করে সেগুলো সিদ্ধ করতে হবে। এরপর লবণ, তেল, মসলা ইত্যাদি চাকের সাথে মেখে টিনের পাত্রে সুন্দর করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে পাত্রটি বায়ুশূন্য করে মুখবন্ধ করতে হবে। একে বলে ফিসকেনিং পদ্ধতি।
৩. বরফ ছোট ছোট টুকরা করে ঝুড়ি বা প্যাকিং বাক্সের তলায় ঘন করে দিয়ে মাছের স্তর সাজাতে হবে। মাছের স্তরে স্তরে বরফ দিয়ে প্যাকিং করে দিতে হবে।
৪. ব্যবসাভিত্তিক মাছ কোল্ড স্টোরেজে কমদামে একসঙ্গে অনেক সংরক্ষণ করা যায়।
৫. বালির ওপর মাছ ছাড়িয়ে দিয়ে অথবা দড়ি টানিয়ে রোদের তাপে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
কখন কোথায় প্রশিক্ষণ নিবেন
দেশের সবগুলো জেলায় বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য নিচে দেয়া হলো।
বিষয়বস্তু : পুকুরের শ্রেণী বিভাগ, পুকুর প্রস্তুত, মাছের খাদ্য, মাছের রোগ ও প্রতিরোধক, ব্যবহারিক
শিক্ষাগত যোগ্যতা : অষ্টম শ্রেণী পাস
মেয়াদ : এক মাস
কোর্স ফি : দিতে হবে না
আসন সংখ্যা : ২০ জন
যোগাযোগের ঠিকানা : জেলা কার্যালয়, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
এ ছাড়াও মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে দেশের প্রতি উপজেলার মৎস্য অফিসে এর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে।
ঋণ সুবিধা
বাংলাদেশের প্রত্যেক তফসিলি ব্যাংক থেকেই মৎস্য চাষীদেরকে ঋণ দেয়া হয়। সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ অথবা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে। ঋণ হ্রাস এবং বৃদ্ধি নির্ভর করে গ্রাহকের লেনদেনের ওপর। গ্রাহক ঠিকভাবে লেনদেন করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারেন।
চিংড়ি চাষ
একজন চিংড়ি চাষী তার মূলধনের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন চিংড়ি চাষের মাধ্যমে। নিম্নে চিংড়ি চাষের বিস্তারিত নিয়ম দেয়া হলো।
১. প্রথমে জমি নির্ধারণ করে জমির চারপাশে দু-আড়াই হাত গভীর ও পাঁচ হাত চওড়া নালা কেটে বিঘাপ্রতি ২০ কেজি চুন ছিটিয়ে দিয়ে ২৫-৩০ দিন জমিটি শুকাতে হবে।
২. শুকনা জমিতে পানি ভর্তি করার সময় নেট ব্যবহার করতে হবে। যাতে কোনো রাক্ষুষে মাছ জমিতে প্রবেশ করতে না পারে।
৩. এরপর দেড় হাজার বাগদার পোনা ও এক হাজার গলদার পোনা ছাড়তে হবে।
৪. মাছের পোনাগুলোকে ব্যাঙ বা সাপ যেন খেয়ে না ফেলে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
৫. নিয়মিত মাছকে খাবার দিতে হবে।
৬. মাঝে মাঝে জমি থেকে মাছ ধরে দেখতে হবে মাছ ঠিক মতো বেড়ে উঠছে কিনা। এ সময় খাবারের মাত্রা আনুপাতিক হারে বাড়িয়ে দিতে হবে।
৭. পাঁচ মাস পরিচর্যার পর বাগদা চিংড়ি বিক্রি করা যায়। আর গলদা চিংড়ির জন্য দরকার আট মাস সময়।
৮. চিংড়ি ঘেরের মধ্যে রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন মাছ চাষ করা যায়।
সফল চাষী
বাগেরহাটের সফল মাছচাষী মো: রুহুল আমিন হাওলাদার ক্যারিয়ার ইনটেলিজেন্সকে বলেন, যখন কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না, ঠিক তখনই আমি মাছ চাষকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছি। এখন আমি সাবলম্বী। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন।
আমি পুকুরে মিশ্র মাছ চাষ করতে চাই। দয়া করে পরামর্শ চাই।