প্যাট্রিস মোটসেপে একজন ‘সিরিয়াল ইনভেস্টর’। ধারাবাহিকভাবে এক খাত থেকে আরেক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে গেছেন তিনি। সেই সুবাদে পরিণত হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন শীর্ষস্থানীয় বিলিয়নিয়ারে। দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও রেখেছেন অনবদ্য অবদান।
এই মুহূর্তে মোটসেপের সম্পদের মূল্যমান ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় তার অবস্থান তৃতীয়। আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তিনিই সবার উপরে। গত বছর মার্চে তিনি আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশনের সভাপতি হন। দাতা হিসেবেও তিনি অসাধারণ। প্রথম আফ্রিকান হিসেবে বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেটের ‘গিভিং প্লেজ’-এ স্বাক্ষর করেছেন তিনি। কথা দিয়েছেন, নিজের সম্পদের অন্তত অর্ধেক ব্যয় করবেন দাতব্য কাজে।
বিভিন্ন সময়ে মোটসেপে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা জনসাধারণের সঙ্গে ভাগ করেছেন, এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকে উপদেশ দিয়েছেন কীভাবে একজন উদ্যোক্তার পক্ষে ব্যবসায় সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
চলুন দেখা যাক, নিজের ব্যবসায়িক জীবনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় মোটসেপের অর্জিত তেমনই সাতটি শিক্ষা, যা অনুকরণীয় হতে পারে আমাদের সবার জন্যই।
ব্যর্থতাকে ভয় পাবেন না
একজন উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ব্যর্থতায় দমে না যাওয়া। মোটসেপে তার এক ইন্টারভিউতে বলেন, ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি অজস্রবার ব্যর্থ হয়েছেন। তার ভাষায়, “আমি আমার জীবনে অসংখ্যবার ফেল করেছি। আমি জানি, ভবিষ্যতেও আমি আরও অনেক ভুল করব। কিন্তু এসব ব্যর্থতা বা ভুলে হতাশ হলে চলবে না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনাকে একটি নতুন ব্যবসা শুরু করতে হবে। হতে পারে সেটি কোনো নতুন কোম্পানি বা রেস্তোরাঁ খোলা, কিংবা মুদি দোকানের ব্যবসা শুরু করা। ব্যবসা যা-ই হোক, আপনাকে শুরু করতে হবে, আর সেখান থেকে ক্রমোন্নতি ঘটাতে হবে।”
নিজের চারপাশে মেধাবী মানুষদের রাখুন
মোটসেপের সফলতার পেছনে আরেকটি নীতি হলো একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কখনোই শিক্ষার্জন না থামানো। তার মতে, আপনার চারপাশে যারা রয়েছেন, তাদের মাধ্যমেই আপনি সেরা ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সমাধান পাবেন। “এজন্য খুবই জরুরি সর্বক্ষণ নিজেকে বুদ্ধিমান ও মেধাবী মানুষে বেষ্টিত রাখা। তাছাড়া এমন একটি সংস্কৃতিও গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আপনার চারপাশের মানুষগুলো ভিন্নমত বা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে উদ্বুদ্ধ হবেন, এবং প্রয়োজনে কোম্পানির সিনিয়রদেরও মতের বিরোধিতা করবেন মার্জিতভাবে।”
এগিয়ে চলুন, স্বপ্ন দেখে যান
মোটসেপে বলেন, “আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন আমার বাবা-মা ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। আমার বাবা আমাদেরকে ভোর পাঁচটায় জাগাতেন যেন আমরা প্রিটোরিয়ার বাজার থেকে ফলমূল ও শাকসবজি কিনে নিয়ে আসি। আর আমরা আমাদের পারিবারিক দোকানটা বন্ধ করতাম রাত বারোটায়। কাউন্টারের পেছনে থাকার সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে ব্যবসায় লাভ বলতে কী বোঝায়। পরবর্তী জীবনে আমি একজন আইনজীবী হই, কেননা এটিই ছিল আমার স্বপ্ন। এক পর্যায়ে আমি বনে যাই একটি মেজর ল’ ফার্মের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পার্টনার। কিন্তু ওই একই সময়ে, আমি বুঝতে শুরু করি যে আমার মূল প্যাশন হলো ব্যবসা। তাই আপনি আজ জীবনের যে পর্যায়েই থাকুন না কেন, আপনি যা করতে চান সেটির স্বপ্ন দেখা চালিয়ে যান। দশ বছর বাদে আপনার স্বপ্ন হয়তো ভিন্ন কিছু হবে। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যাই নেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এগিয়ে চলা, কাজ চালিয়ে যাওয়া, নিজের উন্নতি ঘটানো। কোনো এক জায়গায় থেমে থাকলে চলবে না।”
আগে দরকারি পড়াশোনাটা সারুন
মোটসেপের বিশ্বাস, যেকোনো ব্যবসায় হাত দেওয়ার আগে পর্যাপ্ত সময় নেওয়া উচিত প্রয়োজনীয় গবেষণা, পড়াশোনা ও মূল্যায়নের জন্য। এসবের পেছনে যদি আপনি যথেষ্ট শ্রম ও অধ্যাবসায় বিনিয়োগ করেন, তাহলে সেগুলোই নিশ্চিত করবে যে, আপনার নতুন ব্যবসায় যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা উচিত তার বেশি আপনি করছেন না।
নিজের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করুন, টাকা বড় ব্যাপার নয়
অনেক সাক্ষাৎকারেই মোটসেপে বলেছেন যে হাতে টাকা থাকার মানেই সুখী হওয়া নয়। টাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার স্বপ্নপূরণের পথে ছুটে চলা। সেইসব কাজই করা, যেগুলোতে আপনার অন্তর থেকে আগ্রহ রয়েছে। অর্থাৎ এমন কিছুই করুন, যেগুলো আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার সঙ্গে কাজটি করে চলুন। একসময় আপনি অবশ্যই দারুণ সফল হয়ে উঠবেন। যে কাজে আপনি সবচেয়ে বেশি প্যাশনেট, সেটির উপরই ফোকাস ধরে রাখুন। সকল প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলুন।
নেতিবাচক কথা যারা বলে, তাদের অগ্রাহ্য করুন
মোটসেপে বলেন, “আপনি যদি একটি নতুন ব্যবসা শুরু করতে চান, দেখবেন অনেক মানুষই এসে আপনাকে বলছে যে এই ব্যবসায় আপনি সফল হবেন না।” কিন্তু আফ্রিকান ধনকুবেরের বিশ্বাস, আশপাশের মানুষদের এমন নেতিবাচকতার সাগরে যদি আপনি ডুব দেন, তাহলে কখনোই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন না। বরং আপনি যদি জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রের সফল মানুষগুলোর দিকে তাকান, সবার মধ্যে একটি ‘কমন ফ্যাক্টর’ দেখতে পাবেন। সেটি হলো তাদের পরিশ্রম, আত্মত্যাগ ও স্বপ্নপূরণের দৃঢ়চেতা মনোভাব।
উদ্ভাবনী সত্তাটাকে জাগিয়ে রাখুন
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাকে অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে। কেননা বিজ্ঞানের এই রমরমা যুগে অনেক ব্যবসাই এখন চলে যাচ্ছে প্রযুক্তির দখলে। “আপনি যত অধ্যাবসায়ী ও উদ্যমীই হোন না কেন, নিজের সঙ্গে আপনাকে সৎ হতে হবে। বিশেষত যখন আপনি পরিষ্কারভাবে বুঝে যাবেন যে আপনার ব্যবসা অন্য কিছুর দ্বারা ব্যাহত হচ্ছে। যে বিজনেস মডেল আগে কার্যকর হয়নি, সেটিকেই আঁকড়ে ধরে থাকবেন না। বরং নতুন কোনো মডেল নিজে থেকেই উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যান।”
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার আফ্রিকা