ব্যবসায় মানে ঝুঁকি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও জানার ইচ্ছা জাগে, লস ছাড়া ব্যবসায় কি আদৌ সম্ভব? হুম সম্ভব! যাচাই-বাছাই তথা মার্কেট অ্যানালাইসিস করেই ব্যবসায় লাভবান হওয়া সম্ভব।
আসলে এমন কিছু ব্যবসায় রয়েছে, যাতে লস খুব কম থাকে। আবার কিছু আছে, একদম লস থাকে না। আর কিছু ব্যবসায় আছে যুগোপযোগী। তার চাহিদা কখনো হ্রাস পায় না।
অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবেই আজকের এই লেখায় আমরা এমন কিছু ব্যবসায় নিয়ে কথা বলবো। চেষ্টা করবো সংক্ষিপ্তভাবে লস ছাড়া ব্যবসায়ের আইডিয়াগুলো দিতে।
১. ডিলারশিপ
প্রথমত আমাদের জানতে হবে ডিলারশিপ ব্যবসা কী? সহজ ভাষায় বললে, কোনো কোম্পানির একটা নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের; প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করাকে ডিলারশিপ বলে।
অন্যভাবে বলতে পারি যে, কেউ যদি কোনো কোম্পানির ডিলারশিপ নেন তাহলে, তিনি ঐ এলাকা বা অঞ্চলে সে কোম্পানির পণ্যের বিক্রয়সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে। যিনি এ কাজ করেন তাকে আমরা ডিলার বলি।
এই ব্যবসায় লসের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। কারণ এই ব্যবসায় পণ্য নষ্ট হলে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ডিলারের কোনো লস হয় না। সব কিছু কোম্পানি বহন করে। আরেকটা সুবিধা হলো, যেই পণ্য নিয়ে ডিলার ব্যবসা করবেন, সেই পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া লাগে না, সব কোম্পানি করে থাকে।
এই ব্যবসায় যদি কেউ শুরু করতে চান, তাহলে তাকে আগে নির্বাচন করতে হবে-
কোন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবেন?
তারপর সেই পণ্যের বর্তমান বাজারের অবস্থা দেখতে হবে।
এইসব কিছু দেখে শুরু করতে হবে।
২. স্টক ব্যবসায়
এই ব্যবসা নিয়ে আলোচনার করার আগে আমাদের জানতে হবে স্টক কী? স্টক হচ্ছে- কোনো কিছু সংরক্ষণ করে রাখা। সহজভাবে বললে হবে, কোনো পণ্য গুদামজাতকরণ। সেটা যেকোনো পণ্য হতে পারে। হতে পারে পেঁয়াজ, রসুন, আলু ইত্যাদি। এই ব্যবসায় করার আগে দেখতে হবে যে, কোন পণ্য সিজনাল আর কোনটা নন-সিজনাল।
যারা স্টক ব্যবসা করেন, তাদের বেশিরভাগই নন-সিজনাল পণ্যের গুদামজাত করে থাকেন। তারা এই পণ্য দাম বাড়ার আগ পর্যন্ত ধরে রাখেন।
এই ব্যবসায় ঝুঁকি অনেকাংশে কম থাকে। যেমন-সুপারি, নারিকেল ইত্যাদি।
৩. স্টেশনারি ব্যবসায়
স্টেশনারি বলতে আমরা বুঝি দোকানে খাতা, কলম, পেপার, পেন্সিল, বাচ্চাদের শিক্ষামূলক খেলনা, পড়াশোনার যাবতীয় সরঞ্জাম, কম্পিউটার পণ্য, বই, অফিস সরবরাহ ইত্যাদি বিক্রি করা।
এই ব্যবসায় করতে হলে-
- আগে দোকানের লোকেশনটা দেখতে হবে। লাভজনক করতে হলে দোকানটা নিতে হবে কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস এলাকা বা কোনো আবাসিক এলাকায়।
- তারপর দেখতে হবে এই রকম দোকান আশেপাশে আর আছে কি-না।
- যদি থাকে, তাহলে দেখতে হবে; তার যা সেবা আছে তা তো থাকবেই, অতিরিক্ত কিছু সেবা দিলে লাভজনক হবে কি-না। যেমন-রিচার্জ বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া ইত্যাদি।
এই ব্যবসায় লস হওয়ার আশংকা অনেক কম থাকে। কারণ পণ্য নষ্ট হয়ে যায় না; তাই ঝুঁকি অনেক কম।
৪. ক্লিনিং সার্ভিস ব্যবসা
বিভিন্ন অফিসে বা প্রতিষ্ঠানে সব কিছু পরিষ্কার করার জন্য অফিস ক্লিনিং সার্ভিসারদের ভাড়া করে থাকে। এই সার্ভিসটা শহরগুলোতে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে অনেক ক্লিনিং কোম্পানি রয়েছে। আস্তে আস্তে তা জেলা শহরগুলোতেও জনপ্রিয় হচ্ছে।
- এই ব্যবসায়ে দরকার কিছু দক্ষ জনবল।
- ক্লিন করার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম।
- আর দরকার বেশি বেশি প্রচারের।
৫. বাগান তৈরি
বাগান তৈরি লাভজনক ও লস ছাড়া ব্যবসায়ের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন বাগানের ডিজাইন তৈরি করে, আপনি গ্রাহকদের কাছে অনলাইনে পৌঁছে দিতে পারেন। তারা ডেমো দেখে, ডিজাইন পছন্দ করে আপনাকে অর্ডার দিবে।
এই ব্যবসায় ঠিকভাবে প্রচার করতে পারলে, অনেক বেশি লাভজনক হবে। মানুষের বিল্ডিয়ের বারান্দায় ও ছাদে বাগান তৈরি করে ভালো টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
৬. প্রিন্ট, মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা
প্রথমত এই ব্যবসায়ের জন্য দরকার ভালো একটা লোকেশন। কোন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস এলাকা এবং আবাসিক এলাকা দেখে লোকেশন ঠিক করা। বাংলাদেশের মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং এর ওপর অনেক বেশি আস্থাশীল। বর্তমানে বিকাশ, নগদ, ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং-সহ সব মোবাইল ব্যাংকিং অনেক জনপ্রিয়। এই ব্যবসায় শুরু করতে খুব বেশি মূলধনের প্রয়োজন হয় না, তাই লস ছাড়া ব্যবসা হিসাবে এটাকেও হিসাবে রাখতে পারেন।
৭. লন্ড্রি ব্যবসায়
লন্ড্রি ব্যবসায়ে লাভজনক হওয়ার জন্য দোকানের লোকেশন যাতে কোনো আবাসিক এলাকায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, লন্ড্রি দোকানের বেশিরভাগ কাস্টমার আবাসিক এলাকার। এই ব্যবসাতে লস হওয়ার আশংকা কম থাকে; যদি আবাসিক এরিয়া কেন্দ্রিক হয়।
৮. ফটোগ্রাফি
আমরা সবাই ছবি তুলতে ভালোবাসি; যদি সেই ছবি হয়, ভালো কোনো ক্যামেরায় বা ডিএসএলআর ক্যামেরায়। এমনকি আমরা আমাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, যেমন- বিয়ে কিংবা জন্মদিনের কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে চাই।
বর্তমানে অনেকেই ভাড়া করে ফটোগ্রাফার নিয়ে যান, তাদের স্পেশাল মুহূর্তের ছবি তুলে রাখার জন্য। এই ব্যবসায় কেউ করতে চাইলে তাকে শুধু একটা ক্যামেরা কিনতে হবে। আর নিজের পেশাটাকে প্রচার করতে হবে ফেসবুক বা অন্যান্য অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে। এই ব্যবসায় লসের পরিমাণ নেই বললেই চলে।
৯. কেটারিং
কেটারিং হচ্ছে খাবার পরিবেশন করার ব্যবসায়। আমরা বিস্তারিত আলোচনা করলে সহজ হবে বুজতে।
ধরুন- আপনি খুব ভালো খাবার রান্না করতে পারেন। তা আপনি আপনার পরিচিত বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের রান্না করে খাওয়ালেন। তারা আপনার রান্না খেয়ে অনেক প্রশংসা করলেন।
এবার আপনার মনে হলো- এই ভাবে রান্না করে আপনি বাইরেও খাবার সাপ্লাই দিবেন। আপনি বিভিন্ন অফিসে খাবার সাপ্লাই দিন। তারপর আপনি আরো বেশি প্রফেশনাল হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন বড় বড় প্রোগ্রামে বা বিয়ে বাড়িতে খাবার রান্নার কাজ করতে পারবেন। অথবা আপনি বাসায় বসে রান্না করে খাবার সাপ্লাই দিতে পারেন।
এই ব্যবসায়ে লস হওয়ার আশংকা অনেক কম। কারণ, এইখানে আপনি অর্ডার পাওয়ার পর খাবার সাপ্লাই দিবেন।
১০. ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান
এক সময় মানুষ অসুস্থ হলে প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করতো। সেই সময়ের মানুষের খাবার-দাবার ছিল পিওর। তাদের রোগ বালাই তেমন হতো না।
কিন্তু বর্তমানে মানুষ ভেজাল খাচ্ছে তাদের দৈনন্দিন খাবারে। তাই এখন মানুষ অল্পতেই অসুস্থ হয়ে যায়। এখন তারা অনেক বেশি ওষুধ নির্ভর হয়ে গেছে। ওষুধ ছাড়া তাদের দিন চলে না।
আপনি চাইলে এই ফার্মেসি ব্যবসায় করতে পারেন। শুরু করার আগে ভালো লোকেশন ঠিক করে নিতে হবে। লোকেশন যাতে কোনো হাসপাতাল-কেন্দ্রিক বা জনবহুল এলাকায় হয়। এই ব্যবসায়ে লসের আশংবা অনেক কম।
এই ছিল আজকে লস ছাড়া ব্যবসায়ের আইডিয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আশা করি, উপরের যেকোনো একটি আইডিয়া থেকে আপনার কাঙ্ক্ষিত আইডিয়াটি খুঁজে পাবেন।
লেখক-
অনার্স এন্ড মাস্টার্স ইন ইকোনমিক্স
ইসলামী ব্যাংকার