ছোটবেলায় যখন প্রাইমারিতে পড়তাম তখন ভাবতাম বাবার মতো হব। যখন মাধ্যমিকে পড়ি তখন ভাবতাম, ডাক্তার হব। যখন উচ্চমাধ্যমিকে উঠি ভাবলাম ইঞ্জিনিয়ার হব। কখনো ভাবিনি যে ব্যবসায় করব। আশেপাশের সবাইকে দেখতাম শিক্ষক। আমার দাদা শিক্ষক, আমার বাবা শিক্ষক, শিক্ষক আমার ভাইয়েরা। আমার নানাও ছিলেন প্রসিদ্ধ একজন শিক্ষক। বলতে গেলে বাবা কিংবা মা কোনো গোষ্ঠীতেই ব্যবসায়ী ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে চিন্তা ছিল- বিশ্বের বড় একটি পত্রিকার সম্পাদক হব। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা, সাথে নতুন সময় নামে একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিই। কিন্তু পত্রিকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে গিয়ে হোঁচট খাই। আমরা ছোট মানুষ। তেমন কোন লিংক নেই। তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদেরকে বিজ্ঞাপন দেবে কেন? আমরা ক্রিয়েটিভ কাজ করতে চাই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো কেন আমাদের পেছনে খরচ করবে?
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যবসায়ী হব। নিজে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবো। ক্রিয়েটিভ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো। যেই ভাবা সেই কাজ।
নিজের বন্ধুবান্ধব, ভার্সিটির ছোট ভাই এদেরকে নিয়ে শুরু করলাম ব্যবসায় উদ্যোগ।
কিন্তু ব্যবসায়ের জন্য টাকা কোথায়? ভার্সিটির খরচ ভাই কিংবা বাবার কাছ থেকে আনতে হয়। তাহলে উপায়?
ভাবলাম খরচ কমাবো, টাকা জমাবো। এভাবে করে মাসে ১০০ টাকা করে জমা দিয়ে শুরু করলাম। নামেমাত্র কিছু টাকা জমা হলো। ভাবলাম এবার বিজনেস শুরু করতে হবে।
বাগেরহাটের সাথে যোগাযোগ ছিল অনেক আগেই। সেখানে চিংড়ি মাছের বাম্পার ফলন। শুরু করলাম চিংড়ি মাছের চাষ। ২০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করলাম মাত্র। চিংড়ি বেড়ে উঠছে। দিন গুনছি কবে তা বিক্রি করব। মাঝেমধ্যেই খোঁজ নিই, বড় হচ্ছে…। আশাবাদী হই, শিগগিরই আমরা চিংড়ি বিক্রি করে কিছু টাকা লাভ করব। বড় প্রজেক্ট শুরু করব।
চিংড়ি মাছ তোলার দিন শুরু এসে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই মাছ ধরা হবে। এমনসময় বাগেরহাটের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ফোন দিয়ে জানালো সব মাছ কেমন যেন ভেসে উঠছে। ঘাটের কাছে এসে শুয়ে পড়ছে। সম্ভবত মাছের কোন রোগ হয়েছে। এখনই মাছ ধরতে হবে। এখন ধরতে পারলে অন্তত কিছু খাওয়া যাবে। না হয় সেটাও সম্ভব না। অল্প কিছু মাছ ধরা সম্ভব হল। বাকিরা মরেই গেল। আমাদের আশা এবং প্রজেক্ট এখানেই সমাপ্ত হলো।
আরো টাকা জমছে আমাদের ফান্ডে। এবার নতুন কিছু। আমাদের সহযোদ্ধারা কেউ কেউ বাংলাদেশ পশু-সম্পদ ইনস্টিটিউট থেকে কোর্স করেছেন। পশু পালন করবেন। ভাবলাম তাহলে এবার গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্প কোথায় হবে?
অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বাড়িতে প্রকল্প করা যায়। তার বাবা আছে ভাই আছে তারা দেখাশোনা করতে পারবেন। অথবা অন্য কোনো লোক রাখলেও তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারবেন। যেই ভাবা সেই কাজ।
সেই যশোরের শার্শায় তাদের জমিতে ঘর তোলা হলো। পাকা ঘর। পানির ব্যবস্থা হলো। বিদ্যুতের ব্যবস্থা হলো। পাশের জমিতে ঘাস লাগানোর হলো। ঘাস কাটার মেশিন কেনা হলো। সে এক বিরাট আয়োজন। কেনা হলো গরু। এভাবে চলতে থাকলো কয়েক মাস। সামনে কোরবানির ঈদ। আল্লাহ চাহে তো ভালোই বিক্রি হবে। দশটি গরু লালন পালন চলতে লাগলো। কিছুদিনের মাঝেই হঠাৎ একটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভয়াবহ অসুস্থ। ডাক্তার ডাকা হলো। ওষুধ নেওয়া হলো। কিন্তু গরু আর ভালো হচ্ছে না। মরমর অবস্থা।
খবর এলো সেখান থেকে, এখনই জবাই না করলে গোস্তও পাওয়া যাবে না। গরু জবাই করল, কিছু গোশত বিক্রি হলো। কিছু টাকা পাওয়া গেল।
ভাবলাম ব্যাপার না সামনে ইনশাল্লাহ কুরবানীতে এটা পুষিয়ে যাবে। কোরবানি এসে গেল। বাজারে এবছর গরুর দাম কম। গরুর পেছনে যে পরিমাণ খরচ হয়েছে তা-ও উঠবে না। কোরবানির আগের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো। কিন্তু দাম আর বাড়ছে না। তাই যা পাওয়া গেল, তাতেই বিক্রি করে দেয়া হলো। কিছু লস করে।
সবাই মিলে আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো এ প্রজেক্ট আর চালিয়ে লাভ নেই। এখন ঘর কী হবে? ঘাস কাটা মেশিনই বা কী হবে? শেষ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার বেশি লস।
এরই মাঝে উদ্যোগ নিয়েছিলাম স্কুল করার। সাভারের আশুলিয়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমি চেয়ারম্যান। আমাদের জিটিএফসি গ্রুপের সদস্য ৪২ জন। খুবই বিশ্বস্ত দুজনকে প্রিন্সিপাল- ভাইস প্রিন্সিপাল করে দায়িত্ব দেয়া হলো। তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পাঠদান ব্যবস্থা গড়ে তুলে প্রথম বছরেই ব্যাপক সাড়া পেলাম। দ্বিতীয় বছরের শুরুতে গাড়ি কেনা হলো শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য। নতুন নতুন ডিরেক্টর নেয়া হলো স্কুলের আরো উন্নতির জন্য। কিন্তু বছরের মাঝেই মেঘের ঘনঘটা। স্কুলের দায়িত্বশীলদের আচরণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গ্রুপের সদস্যদের কোনো কথা সহ্য হয় না। অমুককে বাদ দিন, তমুককে বাদ দিন- এমন নানান আবদার। স্কুলের এক অনুষ্ঠানে আমাকে করা হলো আমন্ত্রিত অতিথি। অথচ স্কুলের সভাপতি আমি!
কিছুদিন যেতে না যেতেই খবর পেলাম- স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্টরা আমাদের বাদ দিয়ে নতুন একটি ফাউন্ডেশন গঠন করে সেটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছে। পরিচালনা কমিটির এক মিটিং-এ আমাকে প্রস্তাব দেয়া হলো- জিটিএফসি গ্রুপ চাইলে অন্যান্য ডিরেক্টরদের মতো তাদের সাথে থাকতে পারে। প্রস্তাবটি পছন্দ হলো না। ভাবলাম- ফুল বাগানের মালিই বাগানের মালিকানা দাবি করে বসলো!
খুবই কাছের লোকজন তারা। তাদের সাথে কোনো ধরনের বিবাদে জড়ানো আমার পছন্দ হলো না। বললাম- আমাদের ইনভেস্টমেন্ট তুলে দাও। সদস্যদের মধ্য থেকে আরো কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে ৪২ জনের মধ্য থেকে নিজেরাসহ ১০জন থেকে গেল স্কুলে। বাকি ৩২জন চলে এলাম স্কুল ছেড়ে।
প্রায় দেড় থেকে দুই বছর পর ইনভেস্টমেন্টের কিছু টাকা ফেরত পেয়ে বাগেরহাটে একটি ক্যাডেট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলাম। বেশ সুনাম কুড়ালো প্রতিষ্ঠানটি। এরই ধারাবাহিকতায় ফাস্টফুডের দোকান, জমাজমির ব্যবসায় ও সমবায় সমিতিসহ আরো বেশ কিছু উদ্যোগ নিলাম। পড়ে গেলাম কিছু মানুষের চোখে। বাগেরহাট কোঅর্ডিনেটরকে একেরপর এক রাজনৈতিক মামলায় জড়ানো হলো। প্রায় ছয়টি মামলায় তার নাম জড়িয়ে দেয়া হলো। যদিও তিনি কোনো রাজনীতি করেন না তখন। অনেকটা ফেরারি জীবন তার। এছাড়া আমাদের ব্যবস্থাপনা ত্রুটির জন্য অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো।
আমি ঢাকাতে থাকি। বাগেরহাটের কোঅর্ডিনেটরও এলাকাছাড়া। অবশেষে প্রচুর দায়-দেনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে হলো।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরপরই আমাদের গ্রুপ থেকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করি একটি স্কুল। পরের বছর অনেকটাই হঠাৎ করে আরো একটি ক্যাম্পাস চালু করি।
কিন্তু বাগেরহাটসহ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য দায়-দেনা পরিশোধে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ি আমি ও আমার সহকর্মীরা। জীবন অনেকটা বিষিয়ে ওঠে। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজেদের উপার্জন ও ধার-দেনা করে কিছু টাকা পরিশোধ করি। এরই মাঝে কাপড়ের দোকানসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। ২০১৯ সালে পেছনের সব অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। এরই মাঝে ২০২০ সালের কোভিড-১৯ আবার বাধা হয়ে সামনে আসে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আমরা আল্লাহর রহমতে হারিয়ে যাইনি। যদিও অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল ছুটির এ সময়ে অনেকগুলো দক্ষতা অর্জন করি। যেগুলো কাজে লাগিয়ে করোনার দুই বছর সংসার চালাতে সক্ষম হয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে হয়েছি আরো সাহসী, অভিজ্ঞ ও দক্ষ।
আমি মো: বাকীবিল্লাহ। পড়াশোনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথারঘাটায়। থাকি ঢাকার সাভারে।
বর্তমানে স্কুল নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছি। জিটিএফসি স্কুল অ্যান্ড কলেজকে বিশ্বমানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই। লক্ষ্য ও প্লান অনুযায়ী এগিয়ে চলছে আমাদের কাজ। আশা করছি আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তিই থামাতে পারবে না আমাকে ও আমার সহযোদ্ধাদের। স্কুলের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, প্রকাশনা সংক্রান্ত সকল সেবা দিচ্ছি সুলভমূল্যে।
পরিশেষে সবার কাছে দোয়া কামনা করে আজকের জীবনগল্পের এখানেই সমাপ্তি টানছি। কোনো একদিন আরো সমৃদ্ধ হয়ে বিস্তারিত আকারো শোনাবো- নিজের বলার মতো একটা গল্প!
—
ফেসবুক পেইজ : https://www.facebook.com/bakibillahofficial
উদ্যোগ : জিটিএফসি স্কুল, ক্যারিয়ার ইনটেলিজেন্স, জিটিএফসি ওয়েব সলিউশন, ট্রেন্ডাজ ডটকম, বরগুনা অনলাইন