নওশাদ জামিল : মানুষের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি তার আত্মবিশ্বাস। ২০ বছর আগে আমি যখন ঢাকায় এসেছিলাম কলেজে পড়তে, তখন আমার দুটি মাত্র সম্বল ছিল। প্রথমটা আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টা মায়ের আশীর্বাদ।
ময়মনসিংহের ভালুকার মফস্বল সিডস্টোর বাজারে আমার বাড়ি। সেখানেই বেড়ে ওঠা। গ্রামের স্কুল থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করি। তখন স্কুল থেকে আমি ওই ব্যাচে পেয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি নম্বর। মাধ্যমিক পাস করেই আমি বায়না ধরি, ঢাকার কোনো কলেজে পড়তে যাব। আমার বাবা বললেন, ময়মনসিংহে পড়ো। এখন ঢাকায় পড়তে যাওয়ার দরকার নেই। তখন আমার একমাত্র সাপোর্ট ছিলেন মা।
ঢাকা শহরে কিছুই চিনি না, জানি না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এক কিশোর একাই চলে এসেছিল ঢাকায়। কুড়ি বছর আগের সেই স্মৃতি ভাবলে এখন অবাক লাগে আমারই।
মায়ের দোয়া নিয়ে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি একাই এসেছিলাম ঢাকায়, একাই ভর্তি হয়েছিলাম কলেজে। বাবার প্রচুর জায়গা-সম্পদ থাকলেও পড়াশোনার বিষয়ে খুব বেশি উৎসাহ ছিল না তার। আসল অনুপ্রেরণা ছিল মায়ের।
কুড়ি বছর আগে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না ঢাকায়। তখন গোটা ঢাকা শহরে আমার পরিচিত একজন মানুষ নেই, যার কাছে সহযোগিতা পাব। একজন আত্মীয়-স্বজন নেই, বিপদে-আপদে ভরসা পাব। সামান্য আশ্রয় পাব। একজন মামা, খালা, চাচা নেই; যার বাসায় একরাত থাকতে পারব, যার বাসায় একবেলা খেতে পারব। প্রকৃতপক্ষে তখন ছিলাম খুব একা, নিঃসঙ্গ মানুষ।
আমার ভাগ্য মন্দ নয়। ব্যক্তিজীবনে তেমন কারও সহযোগিতা না পেলেও আমি থামিনি। চলার গতি কখনো বন্ধ করিনি। কেননা আমার সাহস ছিল, আত্মবিশ্বাস ছিল। আর ছিল মায়ের দোয়া। ঢাকায় বসে টের পেতাম মায়ের আশীর্বাদ। বুঝতে পারতাম, আমার সাথে মা আছেন। হঠাৎ শুনতে পারতাম গায়েবি আওয়াজের মতো কণ্ঠ – বাবা! ভয় পেয়ো না!
তখন যোগাযোগের সহজ মাধ্যম নেই। এখনের মতো হাতে হাতে মোবাইল নেই। ২০০০ সালে আমি অল্প মানুষের হাতেই মোবাইল দেখেছি। ইন্টারনেট নেই, ফেসবুক নেই। গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন নেই। যার ফলে ঢাকা থেকে মায়ের সাথে তেমন যোগাযোগ করতে পারতাম না। তার পরও কীভাবে যেন বুঝতে পারতাম, নামাজে বসে আমার জন্য দোয়া করছেন মা। যখন তিনি হাত তুলে মোনাজাত করতেন, তখন কীভাবে যেন বুঝতে পারতাম, অদ্ভুত একহাওয়া এসে প্রশান্তি বুলিয়ে দিচ্ছে মনে!
আমার সবসময়ই মনে হয়, মায়ের দোয়া যার থাকে, কখনও পেছনে তাকাতে হবে না তাকে। আমি সামনে তাকিয়েছি, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি। দুই দশকে মোটামুটি একটা জায়গায় চলে এসেছি। কখনো চলার পথে থেমেছি, ভেবেছি, বিশ্রাম নিয়েছি। তারপর আবার যাত্রা শুরু করেছি। আমি কোথায় যাব, কোথায় থামব, সেটা জানি।
কলেজ-জীবন থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল, মহৎ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হলো, আমি দেশসেরা কবি ও সাহিত্যিক হব। সাংবাদিক হব। এখনও তেমন কিছু হতে পারিনি, কখনো একবিন্দু আশাও ছাড়িনি। লক্ষ্যর দিকে পৌঁছাতে পারব কি-না, কে জানে? আমার এখন মনে হয়, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেয়ে ক্রমাগত এগিয়ে চলাই আসল কাজ। লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময়ে যাত্রাপথের আনন্দ, ব্যথা, কষ্ট ও যন্ত্রণাগুলোই জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময়, উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতা।
ঢাকা স্টেট কলেজ থেকে ২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। তারপর ভর্তি হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, সরকার ও রাজনীতি বিভাগে। মনে আছে, এ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তেমন একাডেমিক পড়াশোনা করিনি। গোগ্রাসে সাহিত্য পড়েছি, দিনরাত দেখেছি সিনেমা, নাটক। তখন ধ্যানজ্ঞানই হয়ে উঠেছিল সাহিত্য ও সাংবাদিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই পার্ট-টাইম কাজ শুরু করি প্রথম আলো পত্রিকায়। তারপর ২০০৯ সালে কালের কণ্ঠে চাকরি জীবন শুরু করি। প্রায় দেড় দশকের সাংবাদিকতা ও দুই দশকের সাহিত্যচর্চায় অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় ইতিমধ্যে অর্জন করেছি বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। কবিতার জন্য পেয়েছি- কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ থেকে আদম সম্মাননা পুরস্কার। সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছি ইউনেস্কো-বাংলাদেশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি।
বিশ বছর আগে ঢাকায় কাউকে চিনতাম না। এখন ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ আমাকে চেনেন, জানেন। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই অসংখ্য মানুষ আমাকে চেনেন, জানেন। একসময় পাবলিক বাসে ঘেমে-নেয়ে চলাচল করতাম, এখন প্রাইভেট কারে চলাচল করি। একসময় হলে থাকতাম, এখন ঢাকায় মোটামুটি বড় একটা ফ্ল্যাটে থাকি।
ঢাকায় অনেক কিছু আছে আমার। খ্যাতি আছে, সম্মান আছে। মধ্যবিত্তের সন্তান হিসেবে নানা কিছু আছে। কুড়ি বছর আগে কিছুই ছিল না আমার। আসলে কি আছে, কি নেই, সেটা জন্য এ লেখা নয়। আসল বিষয় হলো, আত্মবিশ্বাস। দুঃখের বিষয়, ক্ষুদ্রজীবনে আমি কয়েকবার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। কয়েক বছর আগে দুই কুলাঙ্গার ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাসের শেকড় নাড়িয়ে দিয়েছিল। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল, ব্যাপক ক্ষতিও করেছিল আমার। তখন বাস্তবতার কড়াঘাতে কিছুটা হেলে পড়েছিলাম বটে।
আত্মবিশ্বাসী হয়েও দুই কুলাঙ্গারের নেতিবাচক ষড়যন্ত্রে কিছুটা দমে গিয়েছিলাম। আবার আমি উঠে দাঁড়িয়েছি, মাটির নিচের ছড়িয়ে দিয়েছি শেকড়-বাকড়। আমার আর ভয় নেই। কেননা আমি ফিরে পেয়েছি আত্মবিশ্বাস। বিশ্বাস করি আত্মবিশ্বাসই আমার পরম শক্তি ও অনুপ্রেরণার অমিত ভাণ্ডার।
দীর্ঘদিন পরে হলেও উদ্যম, উৎসাহ ফিরে পেয়েছি। মায়ের দোয়া সতত আছে, আত্মবিশ্বাস আছে আমার। এ দুটি শক্তিই আমাকে এগিয়ে নেবে। নিজের পরিশ্রম, একাগ্রতা, সাধনা ও ক্রমাগত পরিশ্রম করার মানসিকতাই আমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। যতদিন বাঁচব, ততদিন আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়েই চলব।
এ লেখাটুকুর একটাই উদ্দেশ্য। সেটা হলো বাস্তবতা যত কঠিন হোক, জীবনজগত যত বিপদসংকুল হোক, কখনও আত্মবিশ্বাস হারাবেন না। কেননা মানুষের গভীরতর শক্তি ও অনুপ্রেরণার নাম আত্মবিশ্বাস।
নওশাদ জামিল : কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। সিনিয়র রিপোর্টার, কালের কণ্ঠ।
সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে চাই দৃঢ় মনোবল
সহমত প্রিয়জন। সত্যিই আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল, শক্তি ও সাহস মানুষকে ানেক দূর নিয়ে যায়।