ডা: সাকলায়েন রাসেল : তুমি কি ডাক্তার হবে? ভেবে বলছ? সত্যিই ভেবে বলছ? আসো না একটু ভাবি-
১। তুমি কি জান…২০১৯ এর খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী..ফেল না করলে MBBS শেষ করতে তোমার ৭ বছর লাগবে। এরপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আরো ৫ বছর !
২। এর মধ্যে এমএস/এমডি কোর্সে ভর্তি হতে MBBS পাসের পর ২ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মানে ৭+২+৫ = ১৪ বছর!
৩। এখানেই শেষ কথা নয়… তুমি হয়ত জান না… উচ্চতর ডিগ্রিতে পাশের হার ১% বা তারও কম… সেক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিতে গড়ে অতিরিক্ত ৩-৫ বছর লাগবে। এর মধ্যে বিয়ে/গ্রামে ২ বছর পোস্টিং মিলে তোমার আরো ৩ বছর নষ্ট হবে। এবার তবে যোগফল দাঁড়াল ১৪+৩+৩=২০ বছর!
৪। এরপরেও কথা আছে। তুমি পাস করা মাত্রই বিশেষজ্ঞ হতে পারবে না। নিদিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে তোমাকে আরো ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে! সর্বশেষ ফলাফল ২০+৫ = ২৫-২৭ বছর।
৫। হিসাবটা এতো সোজাও না। কারণ উচ্চতর ডিগ্রির জন্য চান্স পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়। চান্স পেতেই যদি দেরি হয় তবে বুঝতেই পারছ এ হিসেব কোথায় গিয়ে ঠেকবে!
৬। আচ্ছা তুমি কি এইচএসসি পাসের পর এই ২৫ বছর নিজেকে পড়ালেখায় নিয়োজিত রাখতে প্রস্তুত?
যদি হ্যাঁ হয়, তবে শোন-
১। যতদিনে তুমি MBBS পাস করবে ততদিনে তোমার সহপাঠীরা ছাত্রত্ব শেষ করে পেশায় মনোযোগ দিবে।
২। তুমি যখন উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির সুযোগ পাবে ততদিনে তোমার সহপাঠিরা নতুন প্রমোশন পাবে। বেল চেপে পিয়নকে দিয়ে চা আনাবে।
তুমি কি আরো জানো?
১। তোমার পিতা সংসারের দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দেয়ার প্রহর গুণতে গুণতে একসময় ইহলিলা সাঙ্গ করবেন।
২। তুমি একসময় অর্থাভাবে খেতে পারবে না। কিন্তু যখন অর্থাভাব চলে যাবে তখন তোমার শরীরে ডায়াবেটিস প্রেসারের মতো রোগ বাসা বাধবে। তখনো তুমি খেতে পারবে না !
৩। সামাজিক সব আয়োজন থেকে তুমি থাকবে দূরে। ধীরে ধীরে মানুষ থেকে অসামাজিক জীবে পরিণত হবে।
৪। সন্তানের বেড়ে ওঠা দেখার মতো সময়ও তোমার হাতে থাকবে না।
৫। মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ডাক্তারদের বেশি !
৬। এতো কিছুর বিনিময়ে সম্মান….হাহাহাহা.. বেশিরভাগ সময় গালিই কপালে জুটবে!
তোমার এটাও জানা উচিত-
১। প্রতি বছর ৮০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। মাত্র ৭- ১০ হাজারের মতো চান্স পায়।
২। যারা চান্স পায় না, তাঁদের অনেকেই অন্য পেশায় যোগ দেয়।ডাক্তার না হওয়ার আফসোস অন্তরে থাকলেও একসময় তাঁদের অনেকেই ডাক্তার বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। উঠতে বসতে তারা তোমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবে!
তুমি হয়ত জান না-
১। বিদেশপ্রীতি আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। খেয়াল করলে দেখবা এসব লোক চিকিৎসার জন্য বিদেশের সরকারি হাসপাতালে যায় না। যায় বেসরকারিগুলোতে। তারাই কথায় কথায় তোমাকে কসাই বলতেও কুন্ঠা বোধ করবে না। ভারতের কথাই ভাবো – নচিকেতা ভারতের লোক।ডাক্তারদের কসাই বলেই তিনি বিশেষ স্থান দখল করেছেন। অথচ, তাঁর গান ভারতীয় ডাক্তারদের উদ্দেশেই ছিল।
২। এদেশের বিবেকবানরা চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না রাখলেও পান্ডিত্য ফলাতে পিছপা হয় না।
৩। শুধুমাত্র পাস করছে না বলে প্রতিদিন কতজন যে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বেসরকারি মেডিকেলে এ প্রবণতা অনেক বেশি। অনেকে টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে অনেকে আর আসতে চায় না। এত টাকা নষ্ট করে দেশে ফিরে কী করবে- সেই ভয়ে ফেরারির মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে। বেসরাকারি মেডিকেলেও তাই। এত্তো টাকা খরচ করে অনেকে ফেল করতে করতে আত্মহত্যার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ফিরে আসেএই ভেবে যে, মা-বাবার এত টাকা খরচ করলাম- ডাক্তার না হলে কি হবে!
৪। নিরাপদ কর্মস্থলের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চিকিৎসকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
৫। এদেশে রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। ঔষধের দোকানদার ডাক্তার। পল্লীচিকিৎসক বড় ডাক্তার। পাশের বাড়ির সব জান্তা আপা তাঁর চেয়েও বড় ডাক্তার। ঘরে ঘরে কত শত ডাক্তার। এখন যোগ হয়েছে গুগল ডাক্তার। গুগলে সার্চ দিয়েই যারা তোমার উপর পান্ডিত্য ফলাবে! এদেশের সব লোকই ডাক্তার। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমবিবিএস পাস করে!
জানো কি?
ইন্টার্নি ২ বছর হওয়ার প্রস্তাব আসছে…
এক বছর নিজ মেডিকেলে, এক বছর গ্রামে।
শিক্ষানবিশ হয়ে গ্রামে গিয়ে কী করবা ভেবেছ?
শিখবে কার কাছে? রোগীকেই বা কিভাবে সাহায্য করবে!
তবে এক বছর গ্রামে থাকলে কর্তাদের ম্যালা সুবিধা। গ্রামে ডাক্তার থাকে না এ অপবাদ কমে যাবে। কারণ তুমি সে শুন্যস্থান পূরণ করবে। তুমি প্রস্তুত তো?
তুমি কি জানো?
১। সব পেশাই সেবামূলক। কিন্তু তোমাকে সেবাদানকারীর তকমা লাগিয়ে দেয়া হলেও দিনশেষে তুমি তিরস্কারই পাবে।
২। সব স্টুডেন্টই ট্যাক্সপ্রাপ্ত। সবচেয়ে বেশি পায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবুও শুধুমাত্র তোমার ঘাড়ে অপবাদ ঝুলবে- ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার!
এবার বলো… তুমি কি সত্যিই ডাক্তার হতে চাও?
তবে দোয়া করি…
তুমি ডাক্তারই হও!
কোশ্চেন ইজ- এটা দোয়া না বদদোয়া?
লেখক : ভাসকুলার সার্জন ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট