চাকরি পাওয়াকেই অনেকে জীবনের শেষ লক্ষ্য মনে করে থাকে। তবে চাকরি পাওয়াটাই আসলে শেষ কথা নয়। ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য প্রয়োজন চাকরি পাওয়ার পরে বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগ। এর অভাবে সম্ভাবনাময় একটি ক্যারিয়ারও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর যথাযথ স্থানে যথাযথ মনোযোগ দিতে পারলেই কেল্লাফতে। এরকম কিছু টিপস এই লেখায় জানাচ্ছেন সানজিদা সুলতানা
পড়ালেখা শেষ হয়ে গেলে প্রথম চিন্তাটাই থাকে কী করে ভালো একটি চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু ভালো একটি চাকরি পেলেই কী সব চিন্তা শেষ? প্রশ্নটা শুনে অবাক হতে পারেন অনেকেই। কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। চাকরি পাওয়া মানেই চাকরি জীবনে সফলতা নয়। এর জন্য বাড়তি চিন্তার প্রয়োজন আছে বৈকি। কেননা শিক্ষাজীবনে যেমন চিন্তা ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো ফলাফল করতে হবে, শিক্ষকদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে হবে; তেমনি চাকরি জীবনেও এই প্রয়োজনগুলো রয়েছে ভালোমতোই।
জেনে রাখবেন, আপনি চাকরি পাওয়ার পর প্রথম যেদিন অফিসে যাবেন সেদিনের কিছু কাজ, কাজ করার প্রক্রিয়া, উদ্যোগ, অন্যদের সাথে আপনার কথাবার্তা, এমনকি হাঁটাচলা, নড়াচড়া সবই পরীক্ষকের চোখে লক্ষ করবে সবাই। এগুলোই আপনার সম্পর্কে আপনার বসকে ভালো অথবা মন্দ ধারণা দেবে। আপনার সহকর্মীরা ভেবে নেবে আপনি মানুষটি কেমন। তাই চাকরি পাওয়ার পরের এসব বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।
ভালো কিছু দিয়েই শুরু করুন
প্রতিটি অফিসেই বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা থাকে। এগুলো সবাই ভোগ করতে পারে না। তারাই ভোগ করতে পরে, অফিসে যারা ভালো কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে। তাই প্রথম ২/৩ মাসে অফিসে নিজের ইতিবাচক প্রভাব তৈরিতে একটু বেশিই মনোযোগ দিন। আপনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করুন, যেন অফিসের কোনো কঠিন প্রজেক্টে বা অফিসের কোনো সুযোগের অফার আপনাকেই দেওয়া হয়। মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করুন। সময় এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন। কঠিন পরিশ্রম করুন।
আপনি যদি এই পরামর্শগুলো আত্মবিশ্বাসের সাথে মেনে চলেন, তাহলে দেখবেন অফিস সময় আপনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে দ্রুতই। প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক এবং পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আপনার প্রতিষ্ঠান আপনার কাছ থেকে কতটুকু আশা করে, সে ধারণা থাকা দরকার আপনার। আর সেটা আপনি কতটা কৃতিত্বের সাথে দেখাতে পারবেন, সে সম্পর্কেও আপনার নিজের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। আর তাহলেই আপনি আপনার প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাযথভাবে করতে সক্ষম হবেন। আর না হলে দেখবেন পদে পদে আসবে বাধা।
কর্ণধারদের মেনে চলুন
চাকরি করবেন অথচ বসের আদেশ নিষেধ মেনে চলবেন না, তা তো কল্পনাই করা যায় না। চাকরিতে জয়েন করার প্রথম সপ্তাহেই আপনার বসের সঙ্গে প্রয়োজনীয় নানা ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করুন। সেই সঙ্গে জেনে নিন কী করে আপনার বসকে সন্তুষ্ট রাখবেন। কারণ বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
সুতরাং আপনার বস কীভাবে তথ্য আদান-প্রদান করেন, তিনি কী ধরনের কর্মধারা মেনে চলেন, আপনার সঙ্গে কাজ করার সময় আপনার কাছ থেকে কী ধরনের অংশগ্রহণ তিনি আশা করেন ইত্যাদি মাথায় রেখে তার সঙ্গে কাজ করুন। এমন কোনো কাজ করবেন না, যে জন্য তিনি বিরক্ত হতে পারেন।
বস সংক্রান্ত আরো কিছু
প্রতিদিন কাজ-কর্ম, কথাবার্তা এবং আচার-আচরণ দিয়ে বসকে তো সন্তুষ্ট রাখবেনই, সম্ভব হলে তিন মাস পর পর আপনার বসের কাছ থেকে আপনার কাজের মূল্যায়ন জেনে নেবেন। আর বস ছাড়াও অফিসের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন। এরাই সিদ্ধান্ত নিতে এবং নতুন কৌশল বা উদ্যোগ নিতে প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করে থাকেন।
প্রতিষ্ঠানের এ সকল কর্তাব্যক্তিদের আচরণ, বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, অভ্যাস, পেশাগত বৈশিষ্ট্য, প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখুন। তবে খোঁজ-খবর এমনভাবে রাখবেন, যেন তারা তা টের না পান। সম্ভব হলে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলুন। এর ফলে আপনি বুঝতে পারবেন কী করলে আপনি নিজেকে একই অবস্থানে দেখতে পারবেন।
নতুন নতুন আইডিয়া
আপনার মেধা কতটুকু, তা আপনিই ভালো জানেন। আপনার যদি নতুন কিছু প্রবর্তনের মেধা থাকে, তবে তা কাজে লাগানোর আগে জেনে নিন আপনার কোম্পানি নতুন কিছু গ্রহণের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেয়। বসদের মন-মানসিকতা এবং পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে অনেক কিছুই। আপনার নতুন আইডিয়া তারা কীভাবে নেবেন, তা বুঝে-শুনে শেয়ার করুন।
আর অফিসে নিজের একজন হিতাকাঙ্ক্ষী গড়ে তুলুন, যিনি অফিসে আপনাকে সব ধরনের কাজে সহায়তা করবেন এবং আপনার গাইড হিসেবেও কাজ করবেন। তিনি আপনাকে কোম্পানির নিয়ম-কানুন, আচার আচরণ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অফিসের ভালো-মন্দ আপনার সাথে শেয়ার করবেন। হবেন সামনে এগিয়ে যাবার সহায়ক। তিনি আপনার বসও হতে পারেন বা কোম্পানির সিনিয়র কেউ হতে পারেন। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে মেনে চলতে পারলে চাকরিতে আপনার উন্নতি হবেই হবে।
কিছু টিপস
নতুন চাকরি পেয়েছেন মাত্র ক’দিন হলো। এরই মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় মিস্টি পাঠানো আর বন্ধুদের নিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে ঢুঁ মারার কর্মটি শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু অফিসে গিয়ে কী করবেন না করবেন, সেটা তো অজানাই থেকে গেছে। এখানে নতুন চাকরিজীবীদের জন্য কিছু টিপস দেওয়া হলো।
- প্রথমেই সবার মনে আপনার সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সবাইকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনার সাথে যারা কাজ করছেন তারাও কিন্তু স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তাদেরও উচ্চতর ডিগ্রি বা দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। আপনার কাজ এবং উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি পর্যবেক্ষক হিসেবে কেউ নাও থাকে তবুও এ বিষয়ে সচেতন হোন।
- অফিসে দেরি করে আসা, লাঞ্চে গিয়ে বেশি সময় কাটানো বা অফিস সময় শেষ হবার আগেই চলে যাওয়ার মতো অভ্যাসগুলো যদি প্রথম থেকেই আপনার মধ্যে চলে আসে তাহলে আখেরে কিন্তু আপনার লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। মনে রাখবেন আপনি নিজেকে যতই স্বাধীন ভাবুন না কেন, আপনার আচরণের দিকে কিন্তু সবাই লক্ষ রাখছে।
- ভালো কাজ করার একটি বড় শর্ত হচ্ছে ভালো কাজ শেখা। এ কারণে আপনার শেখার দরজা কখনই বন্ধ করে দেবেন না। অফিসের ‘নর্ম অ্যান্ড কালচার’গুলোও শিখতে চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, যেকোনো অফিসই কিন্তু তাদের মানসিকতার সাথে মানানসই লোককে খুঁজে বেড়ায়। তাই আপনার অফিসের কাজের ধারাটিই আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করুন। আর যদি তাতে পরিবর্তন আনতে চান, তাহলে সেই অনুযায়ী নিজের অবস্থানটি আগে গড়তে হবে।
- নতুন চাকরির শুরুতে কথাবার্তাতেও আপনাকে কিছুটা কেউকেটা হতে হবে। অর্থাত্ খুব বেশি কথা না বললেও সঠিক কথাটি কীভাবে সঠিক জায়গায় বলা যায় সে বিষয়টি আপনাকে শিখে নিতে হবে। আর বাইরের কোনো পরিবেশে যখন আপনি আপনার অফিসের প্রতিনিধি হিসেবে যাবেন তখন এটা মনে রাখবেন যে আপনার কথা বলার ধরণটি শুধু আপনার ব্যক্তিত্বের বিজ্ঞাপনই নয়, একইসাথে এটি আপনার অফিসকেও রিপ্রেজেন্ট করে।
- বড় বড় বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে গিয়ে অনেক তুচ্ছ বিষয় চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে যেন এমনটি না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। যেকোনো অফিসিয়াল ডক্যুমেন্ট বা ই-মেইলের ক্ষেত্রে বানান এবং অন্যান্য ছোটোখাটো তথ্যগত ভুলগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে তারপর তা উপস্থাপন করুন।
- অনাবশ্যক প্রশ্ন পরিহার করুন। যেসব প্রশ্ন আপনার তাৎক্ষণিক কাজের জন্য জরুরি নয়, সেসব প্রশ্ন কোনো একটি স্থানে টুকে রাখুন। পরে সুবিধাজনক সময়ে এগুলোর উত্তর জেনে নিন।
- অন্যদের কাজের দিকে নজর দেওয়ার চাইতে প্রথমে নিজের কাজের প্রতিই বেশি মনোযোগী হোন। নিজের কাজে শতভাগ দক্ষ হয়ে উঠার চেষ্টা করুন।
- অফিস সবসময়ই টিমওয়ার্কের জায়গা। তাই টিমের সাথে কাজ করার জন্য নিজেকে গড়ে তুলুন। এর জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো আত্মস্থ করুন।
- অফিসের পরিবেশের সাথে আপাত সম্পর্কহীন মনে হলেও আপনার ব্যক্তিগত জীবনটিকেও গোছানো রাখার চেষ্টা করুন। কারণ ব্যক্তিগত কোনো কারণে যদি আপনি মানসিকভাবে অস্থির হয়ে থাকেন, তার প্রভাব আপনার অফিসের কাজেও পড়তে বাধ্য।
সূত্র: ক্যারিয়ার, দৈনিক ইত্তেফাক