মাকসুদুর রহমান : আজকের এই অনিশ্চিত সময়ে ভবিষ্যতের চিন্তা করা বা পরিকল্পনা করা আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে জানে ‘আগামীকাল’ কেমন হবে? এবং আমরা কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করব? জীবনে অনিশ্চয়তা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সহজাত এক ধরনের বিদ্বেষ রয়েছে। হোক সেটা তার জীবনের সেরা সময়।
আর এ ব্যাপারে ভালো খবর হচ্ছে, আমাদের মধ্যেই অনিশ্চয়তাকে ভালোভাবে কাজে লাগানোর ক্ষমতা আছে। এই নিবন্ধে আলোচনা করবো অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠার ৭টি কৌশল সম্পর্কে।
১. অনিশ্চয়তাকে জীবনের অংশ হিসেবে নিন
সাইকোথেরাপিস্ট জয়েস মার্টার এলসিপিসি’র মতে,
“মানুষের জীবনে চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এরা আমাদের চেতনার বিবর্তনকে প্রচার করে”।
উপরের উদ্বৃতি দিয়ে এ কথা বোঝা যাচ্ছে যে, মানুষের জীবনে কিছুটা অনিশ্চয়তা মন্দ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামান্য পরিমাণ অনিশ্চয়তা মানুষের সিমপ্যাথিক নার্ভ বা সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রকে সতর্ক ও সক্রিয় করে তোলে। যা আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
২. পরিকল্পনা করুন এবং প্রস্তুত থাকুন
যেহেতু জীবন অনেকাংশেই অনিশ্চিত, তাই আপনাকে আগে-ভাগেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্যও পরিকল্পনা রাখা উচিৎ। আপনার পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং তা যদি কার্যকর না হয় তবে কিছু জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করুন।
রবার্ট বার্নসের বিখ্যাত কবিতা ‘টু এ মাউস’-এর একটি উক্তি আছে,
“ইঁদুর এবং পুরুষদের সেরা পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ হয়”।
তাই সবচেয়ে সেরাটা পরিকল্পনা করুন আর সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
৩. আপনি যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সেদিকে ফোকাস করুন
জীবন নিয়ন্ত্রণে না থাকার অনুভূতি থেকে অনিশ্চয়তা এবং অনেকটা উদ্বেগ ও চাপ তৈরি হয়। যদিও জীবনে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক কিছুই ঘটে। তাই আমরা যে বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সেগুলোতে মনোনিবেশ করা উচিৎ।
উদাহরণস্বরূপ- দৈনন্দিন জীবনের একটা রুটিন তৈরি করে নেয়া। নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর মতো অভ্যাস আপনাকে চালকের আসনে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট অ্যামেলিয়া আলদাও-এর মতে, “অভ্যাসগুলি সয়ংক্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনুমানযোগ্যতা ও নিয়ন্ত্রণবোধ তৈরি করে। এছাড়াও যখন আমরা কোন কাজ শেষ করি তখন এটি আমাদের সফলতার আনন্দ দেয়। যা হতাশার বিরূদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে”।
৪. ইতিবাচক থাকুন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা নেতিবাচক প্রত্যাশাগুলির অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে। কীভাবে কী ঘটবে সে সম্পর্কে আমরা সবসময় উদ্বেগ ও চাপে থাকি। বিশেষত যদি আমাদের মনে হয় যে পরিস্থিতিটির উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন ধরুণ, আমি কি চাকরি হারাব? আমি কি বিশেষ কাউকে খুঁজে পাব? আমি কি সুস্থ থাকতে পারছি?
অনিশ্চিত বিষয়গুলি নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে ভালোভাবে কাজ করার কথা ভাবুন। নিজেকে আনন্দদায়ক ও ইতিবাচক পরিস্থিতিতে কল্পনা করুন। এতে আপনি নিজেকে আরো শান্ত, আত্মবিশ্বাসী ও নিয়ন্ত্রিত বোধ করবেন। ভবিষ্যৎ যখন আপনার কাছে পরিষ্কার নয়, সেহেতু ভিজ্যুয়ালাইজেশন (নিজেকে আনন্দদায়ক ও ইতিবাচক পরিস্থিতিতে কল্পনা) আপনাকে ইতিবাচক থাকতে সাহায্য করবে।
৫. জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করুন
প্রকৃতপক্ষে, আমরা যখন অনিশ্চয়তায় জড়িয়ে পড়ি তখন আমরা সেই মুহুর্তের সৌন্দর্য ও শিক্ষা দুটো থেকেই বঞ্চিত হই। ভবিষ্যতে কী ঘটবে আর কী ঘটবে না, এই নিয়ে যদি আমরা খুব বেশি ভাবতে থাকি তাহলে বর্তমান আমাদের যা দিচ্ছে তা-ও গ্রহণ করতে পারব না।
খাওয়াদাওয়া কিংবা সংগীত শোনার মাধ্যমে আপনি মননশীলতা বা মাইন্ডফুলনেস চর্চা করতে পারেন। মননশীলতা চর্চা আপনাকে অনিশ্চয়তার মধ্যেও স্থির থাকতে সহায়তা করবে।
৬. ছেড়ে দিতে শিখুন
আমাদের মধ্যে অনেকেই যে কোনো পরিস্থিতির একটি নির্দিষ্ট ফলাফল আগে থেকেই আশা করে থাকেন। অনেকেই আবার এই আশাকে বিশ্বাসে রূপান্তর করে ফেলেন। আর যখন ফলাফলে সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটে তখন তারা হতাশ হয়ে পড়েন। আমরা যদি ছেড়ে দিতে শিখি এবং ওই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি তবে আমরা আরো বেশি সম্ভাবনা ও ভালো ফলাফলের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
৭. নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন
অনিশ্চয়তাকে জয় করার অন্যতম একটি সেরা উপায় হলো, চলার পথে যে পরিস্থিতিই আসুক তা সামলানোর জন্য নিজের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রাখা। অনিশ্চয়তাকে সামলানোর ব্যাপারটি মূলত চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়। জীবনে অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলি আপনি যত বেশি সামলাতে সক্ষম হবেন, এগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনার নিজের দক্ষতার উপর তত বেশি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হবে।
নিজের উপর বিশ্বাসের পাশাপাশি যা আপনি এড়াতে পারবেন না, তা গ্রহন করার মানসিকতা আপনাকে অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিবে।
পরিশেষে বলবো, আমরা যেহেতু জানি যে আমাদের জীবন অনিশ্চিত। সেহেতু যত তাড়াতাড়ি আমরা এই অনিশ্চয়তা নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো খুঁজে বের করতে পারবো, ততই মঙ্গল।
আমরা সবাই এটা জানি যে, পরিস্থিতি সবসময় একই আচরণ করে না। অনেক সময়ই আমরা যেমনটা ভাবি, তেমনটা ঘটে না। যদি সবসময় তাই ঘটতো, তাহলে জীবন অনেকাংশেই একঘেয়ে হয়ে উঠতো। তাই আমাদের উচিৎ অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়ে একে নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলি জানা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
সূত্র : essentiallifeskills.net