আনিসুর রহমান এরশাদ : দৈনন্দিন জীবনে নিজের ও অন্যদের আবেগের প্রকাশকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ম্যানেজ করাই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স-ইআই বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা। এটাকে আবেগ সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা বা অনুভূতিজনিত বুদ্ধিমত্তা অথবা ইমোশনাল কোশেন্ট-ইকিউ বলেও নামকরণ করা হয়।
ইকিউ-এর মাধ্যমে পরিমাপ করা হয় সামাজিক ও আবেগগত দক্ষতা এবং মানুষের সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সঠিক আচরণ। বৈরী পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সবেচেয়ে সঠিক পথ বা বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের কৌশল বোঝার দক্ষতা। ইকিউ হচ্ছে- কাজ ও অনুভূতি সম্পর্কে এক ধরনের সচেতনতা, অনুভূতিকে বিস্তৃতভাবে ও বুদ্ধিগতভাবে ব্যবহার করতে পারার ক্ষমতা। অন্যের আবেগ-মানসিকতা-ইচ্ছা-অনিচ্ছা-ভাবনাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা, সবার সাথে মিলে-মিশে-মানায়ে চলার ক্ষমতা। অন্যের সাথে সুসম্পর্ক রাখার দক্ষতা, দ্বন্দ্ব মোকাবিলা ও মীমাংসার মাধ্যমে কর্মস্থলে সুস্থ-শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখায় পারদর্শিতা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। আত্মোপলব্ধি, সামাজিক দক্ষতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, জনবল পরিচালনার দক্ষতা, নিজের ও অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারার ক্ষমতা এবং প্রচেষ্টা-শৃঙ্খলা ও সত্যিকার বিশ্বাস ব্যক্তির সাফল্যময় জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স কী?
ইকিউ হচ্ছে- ব্যক্তির সেই মানসিক সামর্থ্য, যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করতে পারে, আশপাশের অন্যান্যদের সাথে সফলতার সাথে আচরণ করতে পারে, অন্যকে মোটিভেট করতে পারে এবং স্বীয় অনুভূতির সঠিক বিচার করে প্রতিদিনের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যথার্থভাবে সাড়া দিতে সমর্থ হয়।ইকিউ এর বিশেষ গুণটি ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট ছাড়া সবার থাকে না। ফোর্বস জানিয়েছে ইকিউ ভালো থাকার প্রমাণ- কাউকে কোনো কিছু দিলে তার বিনিময়ে কোনো প্রতিদান আশা না করা, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া, সমস্যা কাটিয়ে ওঠতে চেষ্টা অব্যাহত রাখা ও ভবিষ্যতে এমন ভুল যেন না হয় সেজন্য সতর্ক থাকা, মানসিক চাপ সহজেই সহ্য করতে পারা, বিরক্তিকর কিংবা নেতিবাচক চিন্তাধারার মানুষকেও সামলাতে পারা, সবকিছু নিখুঁত নয় ওসামান্য ভুল-ত্রুটি থাকবে এটা মেনে নেয়া, আইন মেনে চলা, অপরাধী না হওয়া, কখন ও কিভাবে না বলতে হবে সে দক্ষতা থাকা, অন্যদের চরিত্র দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ ও নির্ণয় করতে পারা, নিজের কোথায় শক্তি রয়েছে ও কোথায় দুর্বলতা রয়েছে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখা, অন্য মানুষ সম্পর্কেও আগ্রহ, আবেগ ঠিকভাবে নির্ণয় করার ক্ষমতা বেশি থাকা ও পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করা। ইকিউ’র মূল উপাদান হচ্ছে নিজের আগ্রহ, উদ্দীপনা, উৎসাহ, আশাবাদ এবং পজিটিভ কমিটমেন্ট। ইকিউ হচ্ছে- নিজের অনুভূতির প্রতি মনোযোগী হওয়া, অন্যের সাথে দ্বান্দ্বিক আচরণের উৎস ধরা, নিজের ইমোশন শনাক্ত করা।
কেন প্রয়োজন?
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স প্রয়োজন- ব্যক্তিগত জীবনে সর্বোচ্চ সফলতার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, জীবন যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছাতে, অন্যদের আবেগকে মূল্যায়ন করতে, নিজের আবেগ চারপাশের লোকজনের মনে কিরকম প্রভাব ফেলছে তা বোঝতে, কর্মক্ষেত্রে দক্ষ ও দ্রুত আরো বেশী সফল হতে, দীর্ঘ জীবন লাভ করতে, উন্নত স্বাস্থ্য অর্জনে, সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে উন্নীত করতে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা নির্মানে,সামাজিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য।ইকিউ’র দক্ষতা কঠিন পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার মাধ্যমে স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে; মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করায় দুশ্চিন্তা-বিষণ্ণতা-অপব্যবহার-আত্মহত্যার চিন্তার সম্মুখীন হতে হয় না, টেনশন-স্ট্রেস-দুশ্চিন্তার মতো অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলো থেকে অব্যাহতি দেয়, বিরোধ মুক্ত কর্মস্থান ও সুসম্পর্ক মিলে এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা লাভ হয়।আনন্দময় সার্থক জীবন তথা দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, রাষ্ট্রিক জীবনে সফল-জনপ্রিয়-সুখী মানুষ হতে চাইলে ইকিউ’র যথাযথ উন্নয়ন জরুরি।
ইকিউ-সম্পন্ন মানুষের গুণাবলি
ইকিউ-এ এগিয়ে থাকা ব্যক্তিরা বহুমাত্রিক যোগ্যতার অধিকারী, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন গুণাবলি অর্জনে দক্ষতা সম্পন্ন। তারা মনের গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখেন, সবার সাথে মানিয়ে ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার আচার-আচরণ রপ্ত পারেন, আশেপাশের মানুষকে উৎসাহিত ও কর্মোদীপ্ত করতে পারেন, প্রয়োজনে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারেন, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আবেগ নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন, মানুষকে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলি দিয়ে মূল্যায়ন করেন। ব্যক্তির বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে ভেতরের সৌন্দর্যকে মূল্যায়নের ক্ষমতা থাকায় অন্যের সাথে তার ব্যবহার হয় মানবিক, আন্তরিক ও সঠিক। ফলে প্রশাসন, বিক্রয়, বিপণন, মটিভেশন ও উন্নয়ন কৌশলে তাদের সক্ষমতা বেশি। ইকিউ আদর্শ পর্যায়ে থাকলে মানুষকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদায় করে নেয়ার কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। ইকিউ এর জন্য চারটি বিষয়ে চর্চা করতে হয় বা খেয়াল রাখতে হয়। নিজেকে চেনা ও বোঝা বা আত্মসচেতনতা (Self-Awareness), নিজেকে ম্যানেজ করা (Self-Management), অন্যদেরকে বা সমাজকে বোঝা (Others or Social Awareness), সম্পর্ক বা সমাজকে ম্যানেজ করা (Relationship or Social Management)।
যাদের ইকিউ ভারসাম্যপূর্ণ থাকে তারা বিনয়ী, আত্মবিশ্বাসী, সহানুভূতিশীল, খোলা মনের অধিকারী ও দয়াবান হন এবং তাদের নিজেদের প্রকাশ করার ও সীমারেখা নির্ধারণ করার সামর্থ্য থাকে। তাদের সহ্য ক্ষমতা বেশি থাকে, খুব সহজেই বিক্ষুব্ধ হন না, নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন, অন্যরা কী ভাবলো তা নিয়ে চিন্তিত হন না, নিজের আবেগের বিষয়ে নিজেই দায়িত্ব নেন, আবেগ অনুভব করানোর জন্য অন্যদের দোষারোপ করেন না এবং রসিকতা ও অধঃপতনের মধ্যকার পার্থক্য করতে জানেন।তারা দ্বন্দ্বকে মোকাবেলা করায় পারঙ্গম, সীমা লঙ্ঘন করে না, আক্রমণাত্মক আচরণ করে না, ভারসাম্য বজায় রাখে, জটিল ও বিষাক্ত মানুষদের শত্রুতে পরিণত করে না এবং আবেগিয় প্রতিক্রিয়াকে দূরে রাখে।আবেগ ঠিকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় না এবং অযৌক্তিক ও উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। কারো আবেগ না বুঝলে তাকে বুঝা সম্পূর্ণ হয় না এবং বিমর্ষ-হতাশা-নিপীড়িত বা উদ্বিগ্নতাসহ সুনির্দিষ্টভাবে অনুভূতি প্রকাশে ব্যাপক শব্দ ভান্ডার ব্যবহার করতে না পারলে নেতিবাচকতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।
তাই ইকিউ সম্পন্নরা- চিন্তা করার জন্য সময় নেয়, সম্ভাব্য ফলাফল ও পাল্টা যুক্তিতর্কের বিষয়ে বিবেচনা করে, সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ে উন্নত ধারণা প্রস্তুত করে, অন্যদের সাথে চাহিদা অনুযায়ী যোগাযোগ করে এবং অন্যদের মতামত গ্রহণ করে, কী বলছে তা অন্যরা বুঝতে পারে, আচরণের সমন্বয় করার চেষ্টা করে, অন্যরা যাতে বোঝতে পারে এমনভাবে ধারনাকে প্রকাশ করে, স্ট্রেস পুষে না রেখে এড়িয়ে যায়, অসন্তোষ দূর করে, ভালো অনুভুতি দেয়, স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে, ভুলকে নিরাপদ দূরত্বে রাখে, ভুলকে ভুলে যায় না, ভবিষ্যৎ সাফল্যকে সমন্বয় করে, খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়, ব্যর্থতাকে সাফল্যে রুপান্তর করতে পারেন, পড়ে যাওয়ার পরও ওঠে দাঁড়ান এবং দীর্ঘ সময় ভুলের মধ্যে থেকে উদ্বিগ্ন ও লজ্জিত হন না। এমন কিছু পরিস্থিতি-মানুষ-বিষয় থাকে যা উত্তেজিত করে ঝোঁকের বশে কাজ করতে ঠেলে দেয়। ই কিউ সম্পন্নরা উত্তেজিত হবার বিষয়টি পর্যালোচনা করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও এ জ্ঞানকে কাজে লাগায়।
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স যাদের কম
আর দুর্বল ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স সম্পন্নরা খুব দ্রুত মতামত দেন, পক্ষপাত করেন, মতামতের বিষয়ে প্রমাণ জড়ো করেন, মনে অসন্তোষ পুষে রেখে নেতিবাচক আবেগ তৈরি করেন, বিপরীত কোনো প্রমাণকে উপেক্ষা করেন, নিজের মতের সমর্থনে তর্ক করেন, খুব সহজেই মানসিক চাপ অনুভব করেন, নিজেকে প্রমাণ করতে সমস্যায় পড়েন, আবেগিয় শব্দভান্ডার কম থাকে, দ্রুত অনুমান করেন ও তা প্রতিহত করেন। এ ধরনের স্বভাবের ফলে তারা জনপ্রিয় দলনেতা হতে পারেন না, আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, হঠাৎ রেগে যান, রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেন, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বা ফলাফল চিন্তা না করে সাময়িক বা তাৎক্ষণিক ফলকে গুরুত্ব দেন, সামাজিক জটিলতাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচালনা করতে পারেন না, পরামর্শ ছাড়াই ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন, ইতিবাচক ফলাফল অর্জিত হলে নিজে কৃতিত্ব নেন আর ফলাফল নেতিবাচক হলে অন্যকে দায়ী করে তার উপর দোষ চাপায়ে দেন। এরা মানুষের সম্মুখে ভুল বার্তা প্রকাশ করেন, অন্যরা প্রায়ই তাদেরভুল বোঝে, দুঃখ- হতাশা-খারাপ অনুভব করার আবেগ প্রকাশ করে ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়েন; সুখ ও ইতিবাচকতার মুখোশ পরে থাকতে চেয়ে আরো পিছিয়ে পড়েন। ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগকে উপযুক্ত পরিস্থিতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজে লাগাতে পারেন না।
ইকিউ ব্যবহারে দুর্বলতা দূর করার উপায়
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স সঠিকভাবে ব্যবহারের দুর্বলতা দীর্ঘদিন অনুশীলনের মাধ্যমে দূর করা যায়। এজন্য প্রয়োজন নিজের প্রচেষ্টা-শৃঙ্খলা-সত্যিকার বিশ্বাসের মূল্য দেয়া, সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য অন্যদের মতামত ও সহযোগিতা নেয়া, সবার সাথে একাত্মতা বা সবার মনোভাব বুঝে নিজস্ব মতামত গড়ে তোলা। কাউকে ভালো একটি কথা বলতে গিয়েও যা বলতে চান তা ঠিকমতো না বলতে পারায় মূল কথাটি পরিবর্তিত হয়ে তার কাছে ভিন্ন কোনো বিষয় মনে হতে পারে। উদ্দেশ্য ও প্রভাবের মধ্যে এ ধরনের পার্থক্য বিষয়ে সাবধান থাকতে হয়। কোনো একটি পরিস্থিতিতে ভালো বক্তব্য দেওয়ার পরও অন্যদের মতামত জানা ও অন্যদের সুযোগ দেয়ার জন্য থামা প্রয়োজন। কেননা অন্যরাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে পারে। ব্যক্তি কিংবা দলগত যেকোনো আলাপচারিতার ঠিক কোন পর্যায়ে থামা উচিত তা বোঝার জন্য এবং ঠিক সময়মত না বলতে পারার জন্য অনুশীলন প্রয়োজন। নিজের মতামত সঠিকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, সেদিকেও মনোযোগী হোন। নিজের সুক্ষ বিচার বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন এবং তা পরিবেশ অনুযায়ী দৃঢ়তার সাথে প্রয়োগের চেষ্টা করুন।
ইমোশনাল কোশেন্ট কম থাকার লক্ষণ
ইকিউয়ে কোনো সমস্যা রয়েছে কি-না তা বুঝার কিছু লক্ষণ হলো- আপনি প্রায়ই অনুভব করেন যে অন্যরা সঠিক বিষয়টি ধরতে পারছে না এবং এতে আপনি হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যরা আপনার জোকস ও মন্তব্য শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে আপনি আশ্চর্য হন এবং মনে করেন যে তারা অতি অভিনয় করছে। নিজের অধিকার বিষয়ে আগেই সিদ্ধান্ত নেন এবং সেজন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।নিজের কাছ থেকে উচ্চাশা পোষণ করেন, অন্যদের কাছ থেকেও আশা করেন। দলগতভাবে কোনো কাজ করার সময় আপনার নিজের ভুলের জন্য অন্যদের দায়ী করেন। অন্যদের অনুভূতি আপনার কাছে প্রকাশ করতে এলে আপনি তাকে বিব্রতকর বলে মনে করেন।
ড্যানিয়েল গোলম্যানের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স মডেল
ড্যানিয়েল গোলম্যান ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স – এর মডেলে পাঁচটি দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন। দক্ষতাগুলো হচ্ছে- স্ব-সচেতনতা বা আত্মসচেতনতা বা নিজেকে জানা, আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্ব-ব্যবস্থাপনা বা নিজের আবেগের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক দক্ষতা বা সমাজকে জানা, সহমর্মিতা ও প্রেরণা বা স্ব-উদ্যম বা সমাজ ব্যবস্থাপনা।
আত্মসচেতনতা হচ্ছে- নিজের অনুভূতি, দুর্বলতা, সবলতা, নিজের মনন, মানসিকতা, মানসিক সাহস/সামর্থ্য, ভয়, অসামর্থ্য, দক্ষতা-অদক্ষতা, মূল্যবোধ ও লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এসব মাথায় রাখা।
এছাড়াও অন্যদের উপর নিজের সহজাত ও প্রতিক্রিয়াশীল অনুভূতিগুলোর (অতিরিক্ত বিশ্বাস প্রবণতা বা রেগে যাওয়া) প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা। নিজের ক্ষতিকর আবেগ বা মনোবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা বা পরিবর্তিত অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত।
সম্পর্কের মাধ্যমে সহযোগী বা অধীনস্থ কর্মীদের কোনো একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা সামাজিক দক্ষতা।
কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অন্যদের অনুভূতির বিষয়ে সজাগ থাকা সহমর্মিতা। কোনো কিছু অর্জনের জন্য নিজেকে তাড়িত করা প্রেরণা। সামাজিক দক্ষতার জন্য সমাজের পরিস্থিতি বুঝতে পারা, অর্থবহ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, দক্ষ নেটওয়ার্কিং আর অন্যের আবেগকে গাইড করার মতো গুণ থাকা আবশ্যক। সঠিকভাবে নিজেকে মূল্যায়ন; সুস্থ বিবেক বিবেচনা, খাপ-খাওয়ানো বা অভিযোজন ক্ষমতা, উদ্ভাবনী বা সৃষ্টিশীল চিন্তা চেতনা, অঙ্গীকার-সচেতনতা, কর্ম-উদ্যোগ, রাজনৈতিক সচেতনতা, আশাবাদী থাকা, অন্যকে বুঝার ক্ষমতা, বিরোধ বা সংঘাত ব্যবস্থাপনা, দলীয় কাজের প্রেরণা এবং যোগাযোগ ও পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনুভূতির সূক্ষ্ম রূপগুলো নিয়েই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স -এর কাজ।
ইআই সম্পর্কে তাত্ত্বিক স্টিফেন কোভি
বিখ্যাত ম্যানেজমেন্ট তাত্ত্বিক স্টিফেন কোভি ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স -এর উদাহরণ দিয়েছেন। ধরুন – সকালবেলা, অফিস যাবার আগে আপনি চা খাচ্ছেন এবং আপনার ছোট্ট মেয়ে গল্প করতে করতে চায়ের কাপটা আপনার কাপড়ের ওপর ফেলে দিল। আপনি রেগে গেলেন, মেয়েকে বকাবকি করলেন, মেয়ের দিকে খেয়াল না করায় স্ত্রীর সঙ্গেও রাগারাগি করলেন, কাপড় আবার ইস্ত্রি করে পড়া ও দেরি হওয়ায় রাগের মাথায় কিছু জরুরি কাগজ অফিসে নিতে ভুলে গেলেন, তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালালেন, স্পীড বেশি হবার কারনে পুলিশের কাছ থেকে কেস পেলেন ইত্যাদি।একটা খারাপ দিন পার করে সারাদিন শেষে বাড়ি ফিরে দেখলেন মেয়ের মুখ কালো, স্ত্রীও কেমন যেন চুপচাপ। ঘটনাটা অন্যভাবেও হতে পারত। কাপড়ে চা পড়ে যাওয়ার পর সারাদিনের বাকি বাজে ঘটনাগুলো হয়ত হতো না, শুধুমাত্র যদি ঐ মুহূর্তে মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, যদি মেয়ের দিক থেকে ভাবা যেত, কারন সে তো আর ইচ্ছে করে করেনি কাজটা। শুধু বললেই হতো, ঠিক আছে, কিছু হয়নি। এরপর সাবধানে থেকো।
ড্যান হ্যারিসের টেন পারসেন্ট হ্যাপিয়ার বইয়ে আছে, প্রত্যেক মানুষের মাঝে একজন এসহোল বা কুপ্ররোচক শয়তান বাস করে; যে সবসময় নেগেটিভ চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিতে থাকে। এর কাজই হচ্ছে ডিমোটিভেট করা, হতাশ করে দেয়া, সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া আর অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করা। অথচ আমরা জানি কাজ করলেই মানুষ সবচেয়ে বেশি সুখী থাকে আর এসব অস্থিরতা শুধু সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। এই এসহোলকে এড়ানোর উপায় হলো নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখা এবং দিনশেষে চিন্তা করা আমি কি করতে চেয়েছিলাম আর কি করতে পেরেছি, কোথায় ভুল হয়েছে, কেন হয়েছে, কোনখানে ঠিক করা যেতো এবং পরবর্তীদিন সঠিকভাবে করার চেষ্টা করা। অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো ইকিউ এর দক্ষতাও অনুশীলনের মাধ্যমে শাণিত করা যায়।
ইকিউ সম্পন্নদের অভ্যাস
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স সম্পন্নদের অভ্যাসগুলো হচ্ছে- তারা অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন থাকেন, অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে আগ্রহী হন, সঠিক সময়ে বিরতি দিতে জানেন, অন্যের অবস্থান থেকে ভাবার চেষ্টা করেন।এরা নেতিবাচক মতামত বা নিজের সম্পর্কে সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন,সমালোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন এবং অন্যরা কিভাবে চিন্তা করে ও নিজের কথাগুলি অন্যদের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা বুঝতে পারেন। অন্যদের মনোভাবও গুরুত্ব পায় তাদের কাছে। কারো সাথে পরিচিত হওয়ার পর তাকে বিশ্লেষণ করতে পারেন, নিজের ভুলগুলি স্বীকার করে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কঠিন কাজটি তারা সহজে করতে পারেন, নিজেকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের ভুলগুলো ধরতে পারেন এবং আমি দুঃখিত বা আমি ক্ষমা প্রার্থী বলতে দ্বিধা করেন না।কেউই নিখুঁত নয় বুঝতে পেরে দোষী ব্যক্তির প্রতি অসন্তোষ ফুঁসে না রেখে ক্ষমা করে দেন। বাজে পরিস্থিতিতেও হঠাৎ করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না দেখায়েচিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেপরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। চিন্তাগুলো কোনদিকে ফোকাস করবেন তা ঠিক করে সবধরনের নেতিবাচক অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে নিজেকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।কারো সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে, পরিস্থিতি, প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিশ্লেষণ না করে কাউকে বিচার করে না।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী মানুষ বলে- প্ল্যান এ নিয়ে শুধু চিন্তা করো, প্ল্যান বি, সি এর কোনো দরকার নাই। অথচ অনেকক্ষেত্রে একাধিক অপশন রাখা উচিত এবং কোনো কিছুকেই জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্র বা সবকিছুর কেন্দ্রে রাখা উচিত না, কারণ সেটার যেকোনো সময় পতন হতে পারে। যে নিজেকেই কন্ট্রোল করতে পারেন না, অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না তিনি। নিজের টিকে থাকার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।কারো জন্যে অনেক আবেগ নিয়ে বসে থেকে জীবন নষ্ট করলে নিজের সাথেই অবিচার করা হবে। নেতিবাচক আবেগ মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ডেকে আনে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মানবীয় মূল্যবোধ ধ্বংস করে।
পল একম্যান এর তত্ত্ব
পল একম্যান এর তত্ত্ব অনুযায়ী, বিভিন্ন আবেগসংক্রান্ত দিকগুলো ৫টি মূল ভাগে ভাগ করলে সেসব হবে আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, ভয় এবং রাগ। আপনার ভিতরে এরা কোন পরিস্থিতিতে কীরকম আচরণ করে, কোন ধরনের ঘটনা এদের মধ্যে কাকে উজ্জীবিত করে, এটা বোঝার চেষ্টা করুন। যখন এগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করে, কে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। পরিস্থিতি ভালো-খারাপ যাই হোক, খুঁজে পাওয়া কারনগুলো যেন আপনার আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রনের বাইরে পাঠাতে না পারে, সে ব্যপারে সচেতন থাকার চর্চা করুন। ধৈর্য ধরুন, চেষ্টা করুন, এক সময় ম্যানেজ করতে পারবেন। ইকিউ এর অভাবে ভালোবাসার সম্পর্কও অত্যন্ত তিক্ততার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়, বাবা-মার সাথে সন্তানদের সুন্দর সম্পর্কের মধ্যেও কেউ কাউকে না বোঝার দোষারোপ চলে। অফিস আর ভালো লাগছে না, অফিসের বসের ব্যবহার ভালো না; রাগ-বিরক্তি-হাসি-কান্না সবই মাথার ভেতরে আবেগের খেলা। এই খেলা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে আবেগের দাস হতে হয়, ঘটে অযাচিত ঘটনা। আবেগতাড়িত হয়ে এমন অনেক কথা-কাজ করে ফেলা হয়, যা নিজের বা অন্যের মারাত্মক মানসিক বা শারীরিক কষ্টের কারন হয়।
উপসংহার
মানুষের আবেগ তার দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব বিস্তার করে এবং উন্নতি অবনতির কারন হয়। উঁচু মানের ইকিউ থাকলে ভালো নেতা হওয়া যায়, যেকোনো অবস্থায় মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ ও নিজের কর্মীদের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায় এবং সবার কথা শোনে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। যেসব নেতৃত্ব নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে জানে এবং কিভাবে সেটা অন্যদের প্রভাবিত করবে সে সম্পর্কেও অবহিত তারা কোনো সমস্যায় পরলে চিৎকার করেন না বরং মাথা ঠাণ্ডা করে অবস্থা পরিবর্তন করে। নেতিবাচক অবস্থা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে মানসিক চাপ মোকাবিলা করেন, নিজেকে সুশৃঙ্খল রাখেন, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ান এবং নানা দিক খেকে সমৃদ্ধ হন।নতুন আচরণের ব্যবহার বাড়িয়ে পুরাতন ধ্বংসাত্মক আচরণকে দূর করে দিয়ে প্রতিনিয়ত মস্তিষ্ককে নতুন আবেগিয় বুদ্ধিমত্তার আচরণের অনুশীলন করায়ে তা অভ্যাসে পরিণত করেন। তারা জানেন এবং মানেন- দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্টি হতে পারে নেগেটিভ ইমোশন, সহকর্মীদের মাঝে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, মতবিরোধ ও উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক। তাই তারা নিজের আবেগ বুঝতে নিজের স্কিল বাড়ান ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেন। ফলে যে কোনো দ্বন্দ্বকে পজেটিভ ফোর্স হিসেবে রূপান্তর করার শক্তি তাদের মাঝে গড়ে ওঠে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ক্যারিয়ার ইন্টেলিজেন্স