আনিসুর রহমান এরশাদ : কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষা তথা অন্যের সাফল্যে মনঃকষ্ট এবং ঈর্ষা থেকে তৈরি অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভীষণ রকম অপেশাদার আচরণ। কেউ বেশি উন্নতি করলে বা সুবিধা ভোগ করলে ঈর্ষাতুর আচরণ করা, অপবাদ দেয়া, তার কাজের ক্ষতি করা, কাজের খুঁত খুঁজে বের করা, বস বা ঊর্ধ্বতনদের কাছে বানোয়াট অভিযোগ করা, তাকে সবার সামনে হেয় করার পথ খোঁজা দিনশেষে নিজের জন্যও ক্ষতিকর। ব্যক্তিগত আক্রোশে ঈর্ষার বশে কাজ করা, কূটচালের সুক্ষ্ম জালে জড়ানো, আড়ালে অন্যের বিরুদ্ধে কঠিন কূটচাল চালা একজন ভালো মানুষকেও ভিলেন বানিয়ে দেয়। সাধারণত কূটনামিতে অন্যের কষ্ট দেখে আনন্দ পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপকার ঈর্ষাকারীর হয় না। কর্মদক্ষতা বা যোগ্যতা বাড়ে না, মানুষ হিসেবে উন্নত হন না। শুধুমাত্র সহকর্মীর ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়, ঝামেলা বাড়ে, চাকরিটি চলে যায় বা পুরো পরিবার অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। কূটচাল সম্পর্কে একদিন না একদিন সবাই জেনে গেলে ছোট হন ষড়যন্ত্রকারীই। মানুষের হৃদয় ভরা ঘৃণার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না! অন্যদিকে পরকে নিয়ে যারা বেশি মাথা ঘামান, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে আস্থাশীল অবস্থান গড়ে তোলার জন্য সময় দেয়া তার হয়ে ওঠে না, নিজের দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে পারেন না।
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্বস্তিকর কর্মপরিবেশ বজায় রাখে, ভালোভাবে কাজ করার মানসিক শক্তি দেয়, কাজে উদ্যম ও মনোযোগ বাড়িয়ে তুলে। সহকর্মীর বিপদে সহায়তামূলক আচরণ ও সমস্যায় সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ভবিষ্যতে নিজের সমস্যার সমাধান হিসেবে ফিরে আসে। সহকর্মী এগিয়ে যাচ্ছেন ভেবে অসুস্থ উপায়ে তার চেয়ে এগিয়ে যেতে প্রতিযোগিতা ভালো মানুষের পরিচয় নয়; এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়, শত্রুতা বাড়ে। নিন্দাপ্রিয়রা কখনোই সহকর্মী যে বিষয়ে দক্ষ তার কাছ থেকে সেটি শিখে নেন না। এরা সাধারণত তোষামোদী পছন্দ করেন, নিজের প্রশংসা অন্যের মুখে শুনতে পছন্দ করেন। অন্যের ভালো গুণের চেয়ে খারাপ দিকটা বড় করে দেখেন, নিজের কাজকে সবচেয়ে ভালো মনে করেন। অন্যকে ভিলেন সাজিয়ে নিজে হিরো হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চান। অন্যের প্রশংসা করলে নিজেকে হেয় করা হয় ভাবেন, অন্যের কৃতিত্বপূর্ণ কাজকেও নিজের বলে চালান, অন্যের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরির মাধমে নিজেকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হিসেবে তুলে ধরতে চান।
অফিস রাজনীতি খুবই নোংরা বিষয়। যার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয় সুযোগ পেলে সেও তার ক্ষতির চেষ্টা করে। ফলে তা কারোর জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। কর্মক্ষেত্রে নিজের ও অন্যের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা, কাজের জায়গাকে কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। জীবনে ঈর্ষাকাতর হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে স্বনির্ভরতা ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে তা দূর করুন। ঈর্ষা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলে বা হিংসার লাগাম টানতে অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা বাদ দিন, অন্যের প্রশংসা করুন, আত্মনির্ভরশীল হোন, উদার মানসিকতা তৈরি করুন। সহকর্মীর প্রমোশন হলে, প্রকল্পের দায়িত্ব পেলে, বসের পুরস্কার পেলে, আবগেগতভাবে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু নিয়ে গেলে, অনায্য বা পক্ষপাতদুষ্ট মনে হলেই ঈর্ষা অনুভব করাটা হীন অনুভূতি। তার চেয়ে একটু বেশিই যোগ্য নিজেকে ভাবা মানসিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিকে তীব্র করে।
হিংসার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন অনুভূতি ঈর্ষা। হিংসা ক্লান্তিকর ও ক্ষুধার্ত আবেগ- যা মানুষকে সুখী হতে দেয় না, জীবনটাকে বিষিয়ে তুলে, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, মানসিক শান্তির বারোটা বাজায়। ঈর্ষা হলো যা নেই তা পেতে চাওয়া, অন্যকে অলস-দায়িত্বহীন- ব্যর্থ মনে করা। পরশ্রীকাতরতা মনে জন্ম দেয় বিষণ্নতা। ফলে কাজ সম্পাদনে অন্যের স্মার্ট উপায় তার চোখে পড়ে না। নতুন কিছু শেখার সুযোগ পান না, ঈর্ষার অনুভূতির কারণে অসুস্থ বোধ করেন, অসহায় ও আতঙ্কিত বোধ করেন। ক্যারিয়ারটা ভুল পথে আছে মনে করেন, পরিস্থিতি ইতিবাচকভাবে দেখতে পারেন না, লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত হতে পারেন না। নিজেকে আরো উন্নত করার জন্য কাজ করতে পারেন না, নিজের সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন না, নিজেকে অনন্য করে তুলতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারেন না, পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে পারেন না। নতুনকে গ্রহণ করতে পারেন না; ফলে সম্মান বা স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ভালো কর্মীও হয়ে ওঠেন না।
অন্যের মতো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ঈর্ষা আর অন্যেরটা কেড়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা হিংসা। অন্যের সুখবরে বা অন্যের সৌভাগ্যে ঈর্ষাকাতরতা হিংসার পর্যায়েও চলে যায়। ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ হিংসা। হিংসার ঘোরপ্যাঁচে অকল্যাণ, হিংসা কাতরতায় অন্যের ক্ষতির আশা। হিংসা হচ্ছে অন্যের সুখ-শান্তি ও ধনসম্পদ বিনষ্ট-ধ্বংস করে নিজে মালিক হওয়ার কামনা-বাসনা। হিংসুটে ব্যক্তি নিজের অযোগ্যতা ঢাকতে অতি যোগ্যকে হেয় করেন, অন্যেরটা দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে কেড়ে নিতে চান। হজরত লোকমান (আ.) বলেন : হিংসুকের তিনটি চিহ্ন রয়েছে : পেছনে গীবত করে, সামনাসামনি তোষামোদ করে এবং অন্যের বিপদে আনন্দিত হয়। অন্যের যোগ্যতায় নিজের অযোগ্যতার কথা ভেবে মানব অন্তর পরশ্রীকাতরতায় দগ্ধ হন!
হেরোডেটাস বলেছেন, মানুষের অনুকম্পা পাওয়ার চেয়ে মানুষের ঈর্ষা পাওয়া শ্রেয়। কাজের ক্ষেত্রে দোষ খুঁজে না পেলেও ঈর্ষা থেকে অনেক সমালোচকরা সমালোচনায় মুখর হয়, অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি অন্যের জনপ্রিয়তায় অন্তর্দগ্ধ করে, বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব অস্থিরতা তৈরি করে এবং জেলাসির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, কিছু মানুষ তোমাকে পছন্দ করে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে, তুমি তার কোনো ক্ষতি করেছ। তবু তুমি তার কাছে স্রেফ অপছন্দের মানুষ। তোমার হাঁটা-চলা, কথাবার্তা অনেকের কাছেই ভালো লাগবে না। কেউ হয়তো তোমাকে অপছন্দ করে, কারণ তুমি তার চেয়ে ভালো কাজ জান। তুমি জনপ্রিয়, তোমাকে লোকে পছন্দ করে, সেটাও অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ হতে পারে। তোমার চুল তার চেয়ে সামান্য বড় বা ছোট, তোমার গায়ের রং তার চেয়ে খানিকটা উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল— হয়তো কারণটা এমন! কেবল কারও কোনো ক্ষতি করলেই তুমি তার অপছন্দের পাত্র হবে, তা নয়। অপছন্দ ব্যাপারটা আসে ঈর্ষাকাতরতা থেকে। মানুষের সহজাত চরিত্রেই এ অনুভূতির প্রভাব আছে।
কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষা থাকলে তা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। গল্প-আড্ডায় কর্মক্ষেত্র নিয়ে কটুক্তি, অপছন্দের সহকর্মীদের অপ্রীতিকর নিন্দা বা মালিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য পরিবেশকে অসুন্দর করে। ঈর্ষা কর্মক্ষেত্রকে এক ধরণের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে, গুজব ছড়ানোয় বিভ্রান্তি তৈরি করে, নেতিবাচক আবেগ ও শত্রুতার অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়, সময় অপচয়ের কারণ হয় এবং সহযোগিতার অভাব দেখা দেয়।হিংসুক ব্যক্তির আচরণের কারণেই বেশিরভাগক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখা যায় না। ঈর্ষা নেতিবাচক অনুভূতি থেকে উদ্ভূত হয়। একজন অসন্তুষ্ট কর্মচারীর আচরণ অনেকসময় হয় অপছন্দের ও অযৌক্তিক। সহকর্মীদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ প্রদর্শন করলে তারাও একইধরনের আচরণ করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করতে পারে।
<<<<আরো পড়ুন>>>>>