রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় এক দল সুদক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। সাধারণত নাগরিকদের মধ্য থেকে যারা সবচেয়ে উপযুক্ত ও দক্ষ তাদের নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তারা হলো প্রজাতন্ত্রের লোক বা সেবক। এক কথায় সরকারি লোক। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক দপ্তর থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হয় তাদের।
নাগরিকদের মধ্য থেকে দক্ষ কর্মকর্তাকর্মচারীদের বাছাই ও নিয়োগের কাজটা করে পিএসসি বা পাবলিক সার্ভিস কমিশন নামক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্বে রয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। মূলত এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিসেস কমিশন অধ্যাদেশ দ্বারা পিএসসি গঠন করা হয়। প্রজাতন্ত্রের লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্মুক্তভাবে একটি প্রতিযোগিতা হয়। এ প্রতিযোগিতার নামই বিসিএস পরীক্ষা। প্রজাতন্ত্রেরে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে গঠন করতে চাইলে আপনাকে বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা দিতে হবে।
ক্যাডারসমূহ
বর্তমানে সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের সংখ্যা ২৮টি। যা আবার দুইভাগে বিভক্ত। যেমন- ক. সাধারণ এবং খ. পেশাগত ও কারগরি।
সাধারণ ক্যাডারগুলো হচ্ছে বিসিএস প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, নিরিক্ষা ও হিসাব, আনসার, শুল্ক ও আবগারি, সমবায়, খাদ্য, পরিবার পরিকল্পনা, অর্থনীতি, ডাক, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক, কর, বাণিজ্য, ইকোনমিক ও তথ্য। পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডার গুলো হলো বিসিএস সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, স্বাস্থ্য, তথ্য, সওজ, রেলওয়ে প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত, পশুসম্পদ ইত্যাদি।
পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ
একজন প্রার্থীকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য অন্তত চারটি ধাপ পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করতে হয়। যথা- প্রিলিমিনারি অবজেকটিভ টেস্ট, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন।
প্রিলিমিনারি টেস্ট
* প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক (MSQ) প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন থাকবে ১০০টি এবং মান হবে ১০০।
* প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ০.৫০ নম্বর কাটা যাবে।
* প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য পাবেন-১ নম্বর।
* পরীক্ষার সময় ১ ঘণ্টা।
* নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান : বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন হয়।
লিখিত পরীক্ষা
লিখিত পরীক্ষার বিষয়সমূহ ও নম্বর বণ্টন :
মোট নম্বর ৯০০
১. সাধারণ ক্যাডারের জন্য-
ক. বাংলা ২০০
খ. ইংরেজি ২০০
গ. বাংলাদেশ বিষয়াবলি ২০০
ঘ. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ১০০
ঙ. গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা ১০০
চ. সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ১০০
২. প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য-
ক. বাংলা ১০০
খ. ইংরেজি ২০০
গ. বাংলাদেশ বিষয়াবলি ২০০
ঘ. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ১০০
ঙ. গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা ১০০
চ. সংশ্লিষ্ট পদের জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয় ২০০
[বি. দ্র. যে সকল প্রার্থী সাধারণ ও প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল উভয় ক্যাডারের পদে পছন্দক্রম দিতে ইচ্ছুক তাদেরকে সাধারণ ক্যাডারের ৯০০ নম্বরের অতিরিক্ত প্রফেশনাল ক্যাডারের ২(চ) নং-এর সংশ্লিষ্ট পদের জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ২০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে।]
মৌখিক পরীক্ষা
* কেবলমাত্র লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরাই মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য হবেন।
* মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ এবং পাস নম্বর ৪০।
* মৌখিক পরীক্ষায় আলাদাভাবে পাস করতে হবে।
* মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় শিক্ষা বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত মূল অথবা সাময়িক সনদ অবশ্যই দাখিল করতে হবে। অবতীর্ণ প্রার্থীদের অবতীর্ণ প্রত্যয়নপত্র, সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত/ স্থানীয় সরকার সংস্থায় চাকরিরত প্রার্থীদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়পত্র এবং সোনালী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত আবেদনপত্র ক্রয়ের রসিদের মূল কপি মৌখিক পরীক্ষার আগে বোর্ডে দাখিল করতে হবে। অন্যথায় মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে না।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
কমিশন কর্তৃক চূড়ান্তভাবে মনোনয়নের জন্য প্রার্থীগণকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল বোর্ডের সম্মুখে উপস্থিত হতে হবে। মেডিক্যাল বোর্ডে স্বাস্থ্য পরীক্ষাকালীন যেসব পুরুষ প্রার্থীর উচ্চতা র্৫- এর কম এবং যেসব মহিলা প্রার্থীর উচ্চতা র্৪-১র্০র্ এর কম হবে তারা কোনো ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য শারীরিকভাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। পুরুষ প্রার্থীর ওজন ৪৫ কেজির কম এবং মহিলা প্রার্থীর ওজন ৪০ কেজির কম হলে তারাও অস্থায়ীভাবে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। প্রার্থীগণকে বিধি অনুযায়ী দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা, অন্যান্য তথ্য যাচাইয়ের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয় ।
আবেদনকারীর যোগ্যতা
* যেকোনো বিষয়ে ন্যূনতম ৪ বছর মেয়াদি স্নাতকবা স্নাতক (সম্মান) অথবা ৩ বছর মেয়াদি স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। সে প্রার্থীকেই অবতীর্ণ প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হবে যার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর লিখিত পরীক্ষা ৩২তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদনপত্র গ্রহণের শেষ তারিখের মধ্যে শেষ হবে।
* সাধারণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর হতে হবে।
* মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের প্রার্থীদের জন্য ২১ থেকে ৩২ বছর।
* বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের শুধু উপজাতীয় প্রার্থীদের বেলায় ২১ থেকে ৩২ বছর।
আবেদনপত্র
* প্রিলিমিনারি টেস্টের জন্য সংগৃহীতব্য বিপিএসসি ফরম- ১ এর তিনটি অংশ রয়েছে : প্রথম অংশÑ তথ্য সংবলিত, দ্বিতীয় অংশÑ পরিচিতি প্রতিপাদন এবং তৃতীয় অংশ- প্রবেশপত্র।
* বিপিএসসি ফরম-১, বিপিএসসি ফরম- পূরণের নির্দেশাবলি, বিসিএস পরীক্ষার প্রার্থীদের জন্য অবশ্য পালনীয় নির্দেশাবলি ও জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ এবং সিলেবাস ২০০ (দুইশত) টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা যাবে। ক্রয়ের তারিখ থেকেই আবেদনপত্র জমা দেয়া যাবে।
* প্রার্থী যে কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক তাকে ওই পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ফরম সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রভিত্তিক শাখা থেকে ক্রয় করতে হবে।
আবেদনপত্র পূরণ
* বিপিএসসি ফরম- ১ এর যাবতীয় অংশ অবশ্যই কালো কালির বলপয়েন্ট কলম দিয়ে পূরণ করতে হবে।
* বিপিএসসি ফরম-১ এর সাথে যা সংযুক্ত করতে হবে- চালান/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফটের মূলকপি।
– আবেদনপত্র ক্রয় রসিদের সত্যায়িত ফটোকপি।
– সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সত্যায়িত মূল/ সাময়িক/ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ প্রত্যয়নপত্রের ফটোকপি।
– সত্যায়িত উপজাতীয় সনদ ও মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রমাণের সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
আবেদনপত্র জমাদান
*আবেদনপত্র জমাদানের শেষ তারিখ অফিস সময়ের মধ্যে অবশ্যই প্রার্থীকে নিজে অথবা তার মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে হাতে হাতে জমা দিতে হবে। তবে মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে আবেদনপত্র জমা এবং প্রবেশপত্র গ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থীকে মনোনীত ব্যক্তির স্বাক্ষর সত্যায়িত করে একটি প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে।
* কাগজপত্র/ডকুমেন্ট কোনোভাবেই বিপিএসসি ফর্ম-১ এর সাথে স্ট্যাপল করা যাবে না।
* বিপিএসসি ফরম- ১ ও কাগজপত্র ন্যূনতম 9 ইঞ্চি× 12 ইঞ্চি সাইজের ইনভেলাপে মুখ খোলা অবস্থা জমা দিতে হবে।
* ইনভেলাপের ওপর ‘৩২তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদনপত্র’, ডান কোনায় কেন্দ্রের নাম এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের দফতরের নাম লিখতে হবে।
[বি: দ্র: উপরোল্লিখিত তথ্য ও নির্দেশনা, ৩১তম বিসিএস বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য উৎস থেকে নেয়া হয়েছে। পিএসসি যে কোন সময় এ নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে।]
কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করতে হলে বহুমুখী পড়াশুনার বিকল্প নেই। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নিজেকে আপডেট রাখার চেষ্টা করা। নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করা। এছাড়া বাজারে বিসিএস সম্পর্কিত অনেক বই পাওয়া যায়, যা অনুসরণ করতে পারেন। তাছাড়া বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ওপর ভালো ধারণা রাখতে হবে। এসব বিষয় থেকে বিসিএসে সাধারণত কী ধরনের প্রশ্ন আসে আসুন তা সংক্ষেপে জেনে নিই।
বাংলা
বাংলা প্রশ্নগুলো হয় ব্যাকরণ ও সাহিত্য থেকে। ব্যাকরণ অংশে সাধারণত নবম-দশম শ্রেণীর বোর্ড প্রবর্তিত বই থেকে সমাস, কারক, ক্রিয়া, শব্দ, সন্ধি প্রভৃতি বিষয় থেকে প্রশ্ন আসে। তাছাড়া বিপরীত শব্দ, দ্বিরুক্ত শব্দ, বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন শিখে রাখতে পারেন। সাহিত্যাংশে কবি সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন আসে।
ইংরেজি
বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ইংরেজি প্রশ্নগুলো সাধারণত গ্রামার নির্ভর হয়ে থাকে। তাই নিয়মিত গ্রামারটা ভালোভাবে পড়ুন। নিয়মিত ইংরেজী সংবাদপত্র, ইংরেজী সংবাদ, সিনেমা দেখুন। সাম্প্রতিক বিষয়গুলো ইংরেজীতে ছোট ছোট প্যারাগ্রাফে লেখার চেষ্টা করুন ।
সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত প্রযুক্তি, বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কৃত তত্ত্ব, অবদান এবং বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানীদের তালিকা করে পড়ুন। আরো পড়ুন মাধ্যমিক বিজ্ঞান বইসহ এ সংক্রান্ত বই-পুস্তক।
মানসিক দক্ষতা ও গণিতিক যুক্তি
এখানে এসএসসি পর্যায়ের বই থেকে প্রশ্ন বেশি আসে। তাই সংখ্যাতত্ত্ব, গণিতের ধারা, লাভ-ক্ষতি, সুদ-কষা নিয়মিত চর্চা করুন। বীজগণিতের সূত্রগুলো থেকেও দু একটি প্রশ্ন আসে। জ্যামিতির কিছু সাধারণ অনুমিতি, উপপাদ্য নিয়মিত দেখার চেষ্টা করুন।
সাধারণ জ্ঞান
এখানে দেশি-বিদেশী সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে বেশি প্রশ্ন আসে। সংবিধান, মন্ত্রিসভা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সাম্প্রতিক অনুষ্ঠান, সব কিছু থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। তাই প্রতিদিনের ঘটনাগুলো নিয়মিত জেনে নিতে হবে। বিশেষ করে পরীক্ষা শুরু হবার এক/দুই সপ্তাহ আগের ঘটনাগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। দৈনিক পত্র-পত্রিকা পড়ুন। বিভিন্ন চ্যানেলের খবর নিয়মিত দেখুন। সাধারণ জ্ঞানে ভালো করার সবচেয়ে বড় উপায় হলো চোখ কান খোলা রাখা।
সর্বোপরি নিজের উপর আস্থা রাখুন। বুকের ভেতর গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যান। দেখবেন সাফল্য ধরা দেবে আপনার হাতেই।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কি বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারবেন?