বেশিরভাগ মানুষ তাদের পেশা নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। অল্প কিছু মানুষই আছেন যারা নিজের নির্বাচন করা পেশা বা ক্যারিয়ার নিয়ে অনড় থাকেন। অনেকেই আছেন ছাত্র অবস্থায় যে প্ল্যান নিয়ে শুরু করেছিলেন তা কর্মজীবনে এসে পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এসবের অনেক কারণ আছে। যা-ই হোক, পেশা কী? পেশা নির্বাচন কিভাবে করবেন -এ ব্যাপারে কিছু ধারণা দেয়া হলো এ নিবন্ধে।
পেশা কী?
পেশা শব্দের ইংরেজি Profession হচ্ছে কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ পরবর্তী জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি বা অন্য কোনো বৃত্তিবিশেষ। এর মাধ্যমে তিনি অর্থ উপার্জন করেন বা জীবিকা নির্বাহ করেন। সাধারণ জনগণ প্রায়শই তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে অনেক ধরনের শিক্ষালাভ করতে পারেন। শিক্ষক, আইনজীবি, প্রযুক্তিবিদ পেশাদারীত্বের অনন্য উদাহরণ। (উইকিপিডিয়া)
পেশা নির্বাচন
পেশা নির্বাচন করার সময় অবশ্যই নিজের ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন, এতে করে কাজের প্রতি যেমন একাগ্রতা তৈরি হয়, স্বীকৃতিও পাওয়া যায়। সৎ থেকেই মোটামুটি আর্থিক সমৃদ্ধি, পদন্নোতি, ব্যবসায়িক মুনাফা বৃদ্ধি, বিদেশে প্রশিক্ষণ, নতুন কিছু উদ্ভাবন ইত্যাদি পাওয়া সম্ভব।
অথচ আমাদের ঘটে ঠিক তার উল্টো। অবুঝ সন্তানটির ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে ভালো লাগে না, কিন্তু বাবা-মায়ের তথাকথিত স্ট্যাটাস বৃদ্ধির জন্য সন্তানের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সেই ছোট বয়স থেকে। লেখাপড়া তো নিজের কাছে। নিজে লেখাপড়া না করলে বিশ্বের কোনো স্কুল আপনাকে শিক্ষিত করতে পারবে না। আমাদের দেশে যারা শীর্ষ ব্যক্তিত্ব রয়েছেন (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, আমলা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী) প্রায় সবাই গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে শহরে এসেছেন। বড় হবার মানসিকতা থেকেই তাঁরা আজ দেশের দশ জনের একজন। আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যেই জীবন পার করছেন।
আবার যারা শিক্ষিত ঘরের সন্তান, টাকা পয়সার মধ্যে বড় হয়েছেন, তারা অনেক সময় নিজেদের সেইভাবে মেলে ধরতে পারেন না। কী বলবেন, এই সন্তানরা সুযোগ সুবিধা কম পেয়েছে? বিষয়টা তা নয়। দেখা যাচ্ছে, এই সন্তানদের ওপর তাদের অভিভাবকদের সবকিছুতে চাপ থাকে। কোন স্কুলে পড়বে, কোন বিভাগে পড়বে, কোন পেশায় যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সব কিছু যদি অভিভাবকেরা ঠিক করে দেন, তবে নতুন কিছু আশা করা ভুল হবে। একজন কৃষক কখনও তার সন্তানকে বলে না, তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। সন্তান তার পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। তারা নিজের পছন্দের কাজকে ভালোবাসে তা-ই সফল হয়।
আমাদের দেশে আরেকটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। সবাইকে বিএ, এমএ ডিগ্রিধারী হতে হবে। এটা ভালো লক্ষণ না। যার পুঁথিগত বিদ্যা ভালো লাগে না, তাকে কেন জোর করে বই পড়তে হবে। অনেকের কারিগরি কাজে প্রচণ্ড আগ্রহ থাকে। তারা কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী নিজ নিজ বিষয়ের উপর হবে অত্যন্ত দক্ষ। দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক রেমিটেন্সের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।
বাবা জীবনে ডাক্তার হতে পারেননি, সন্তানকে ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বেন। সরকারি, না হলে বেসরকারি, সেটাও না হলে বিদেশ থেকে ডাক্তারি পড়িয়ে আনবেন। সন্তানের কী ইচ্ছা, সেটা জানার প্রয়োজন কয়জন পিতা-মাতা করেন? এই প্রতিফলন কর্মজীবনেও দেখা যায়। অমুকের ছেলে সরকারি চাকরি করে, তোমাকেও করতে হবে।
কী দরকার? আপনার সন্তান যদি ব্যবসায় করতে চায়, তবে তাকে সেই সুযোগ দিন। যে কাজই করুক, শীর্ষে উঠতে হবে। এই মানসিকতা তৈরি করতে সহায়তা করুন। স্ট্যাটাস নিয়ে চিন্তা করবেন না। সেটা এমনিতেই চলে আসবে।
অনলাইন ভিত্তিক খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সালমান খান ২০০৬ সালে আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে একাডেমির কাজে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কি বলবেন আপনি, সালমান খানের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? এখন বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ মিডিয়া ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি একজন।
যেভাবে উপযুক্ত পেশা নির্বাচন করবেন
পেশা নির্বাচনের আগে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল করুন-
ক্যারিয়ার ট্রেন্ড নিয়ে ভাবুন
পেশা নির্বাচনের আগে আমরা শুধু বর্তমানের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করি। অদূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে বা ট্রেন্ড কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত নই। তাই শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো রেজাল্ট করার পরেও খুব নিম্ন মর্যাদার পেশায় নিয়োজিত হন।
আবার অনেকে কর্মজীবনের এক পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। কারণ তার পেশা নির্বাচন ভুল ছিল। পেশা নির্বাচন করার আগে অন্তত এখন থেকে আরো ২০ বছর আগের এবং পরের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করুন। নির্বাচন করার পর আর পরিবর্তন করা ঠিক না।
তবে জীবনের কোনো পর্যায়ে পেশা নির্বাচন ভুল মনে হলে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হোন।
পেশা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে তা জানতে দেখুন এই নিবন্ধটি। পেশা পরিবর্তন করতে চান?
পেশা নির্বাচন হোক মাধ্যমিক থেকে
প্রাইমারি লেভেলের পড়াশোনা শুরুর দিকেই ক্যারিয়ার চিন্তা থাকা ভালো। কিন্তু তখন আপনার নিজের পরিপক্কতা না থাকায় এই বিষয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে নেওয়া যেতে পারে।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পেশা নির্বাচন করে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিৎ। এখান থেকেই শুরু হয় বিভাগ নির্বাচন। বিজ্ঞান, ব্যবসায়, মানবিক। আপনি যে পেশায় যেতে চাচ্ছেন সে অনুযায়ী নির্বাচন করুন। এ বিষয়ে আরো জানতে পড়ুন মাধ্যমিকে কোন গ্রুপ : সায়েন্স, আর্টস নাকি কমার্স?
পছন্দের পেশাজীবীদের থেকে জানুন
যে পেশায় যাবেন বলে ঠিক করেছেন তাতে কেমন কাজ করতে হয়, দায়িত্ব কী – তার ধারণা নিন। সম্ভব হলে পেশা নির্বাচনের পর ওই পেশার কারো সাথে এক বা দুই দিন কাজ করে দেখুন। এটা অনেক বেশি ফলপ্রসু। তখন পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে সাজিয়ে নেওয়া যায়। সিরিয়াস হওয়া যায়।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের প্রথম সারির পছন্দ হচ্ছে- ডাক্তারি পড়া এবং ডাক্তার হওয়া। কিন্তু কেউই অন্তঃত একদিন ডাক্তারের সাথে সময় দিয়ে বুঝে দেখেননি কিভাবে একজন ডাক্তার কাজ করেন। শুধু নির্বাচন করাই শেষ নয়। পেশাটি আপনার জন্য কেমন হবে, তা দেখে নেয়া উচিৎ।
নিজেকে পেশার উপযোগী করে গড়ে তুলুন
আপনি নিশ্চয় পড়াশোনা করা শুরু করছেন নিজের নির্বাচন করা পেশাতে জায়গা পাবার জন্য। কিন্তু মনে রাখুন, কোনো পেশাই সফল হয় না যদি ভালো পড়াশোনা না থাকে। পড়াশোনার সাথে দরকার অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। পেশার সাথে সম্পর্কিত দক্ষতাগুলো অর্জন করুন।
সর্বশেষ প্রযুক্তি দেখতে হবে। পড়াশুনা করার ক্ষেত্রে শুধু অ্যাকাডেমিক কারিকুলামে পড়ে থাকলে হবে না। খুঁজতে হবে যত সোর্স পাওয়া যায়। সবার আগে এবং পরের কথাটা হচ্ছে- শিখতে হবে। মনে রাখুন- পেশা নির্বাচন করাই আসল কথা নয়, কাজ করে দেখানোই হচ্ছে আসল।
দরকার হবে রিকমেন্ডেশন
আমাদের দেশের জুনিয়র ছাত্র কিংবা চাকজীবীরা সিনিয়রদের সাথে কথা বলেই শুধু চাকরি চেয়ে। ভাইয়া বা আপু, একটা চাকরি দেন। অথবা আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন না!
এক সময় এতে কাজ হতো। তখন এত মানুষ ছিল না। রেফারেন্স দিলেই চাকরি হতো। এখন রিকমেন্ডেশন লাগে শুধু রেফারেন্সে কাজ হয় না। অর্থাৎ আমি কাউকে কোনো পোস্টে দিতে গেলে আমার রিকমেন্ডেশন করতে হবে, অর্থ্যাৎ মোটামুটি গ্যারান্টি।
তাহলে বুঝুন, কে নিতে চায় এত ঝামেলা? যখন জুনিয়র কেউ মাঝে মধ্যে যোগাযোগ করে শুধু বলে- চাকরি চাই, দিন না! তখন অনেকেই বিষয়টা আমলে নিতে চান না। শুধু হু হা করেই শেষ করেন।
তাই অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলুন। আপনি রিলেটেড বিষয়ে ছোটখাটো তথ্যও জানতে চাইতে পারেন। আপনার ধারণা জানাতে পারেন। যে কেউ এসব আলাপে আপনাকে সাহায্য করবে। কখনোই বলবে না যে, এসব নিয়ে আলাপ করো না। সিনিয়র যদি সেই বিষয়ে না জানেন তবে তার উপকার হবে, তিনি জানার চেষ্টা করবেন। এভাবেই আপনি অভিজ্ঞদের কাছাকাছি যেতে পারেন। পেশা জগতে এসবের অনেক ভ্যালু। আপনার সাথে এ ধরনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকলে, তখন আপনাকে কোথাও রিকমেন্ড করতে সেই সিনিয়রের খুব চিন্তা করতে হবে না।
সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ করুন। নেটওয়ার্ক তৈরি করুন। এমন নয় যে সবাই আপনাকে রিকমেন্ড করবেন। কেউ না কেউ তো অবশ্যই করবেন।
কিভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন এ ব্যাপারে জানতে পড়ুন আমাদের এই আর্টিকেলটি। সফল ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিংয়ের অপরিহার্য ৫ উপাদান
সাধারণ দক্ষতা বাড়ান
চাকরির ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির অনেকটা নির্ভর করে ভালো ইংরেজি জানা ও তার সঠিক ব্যবহারের ওপর। বিশেষ করে যাঁরা বড় প্রতিষ্ঠানে বা মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাঁদের তো ভালো ইংরেজি জানার কোনো বিকল্প নেই। ইংরেজি বলতে পারা, লিখতে পারা, পড়তে পারা ও বুঝতে পারা—সবদিকেই জোর দিতে হবে।
তবে একটি কথা মাথায় রাখতে হবে, আপনি যতই ইংরেজি শিক্ষার সার্টিফিকেট অর্জন করেন না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি তা আপনার ব্যবহারিক কাজে প্রয়োগ করতে পারবেন।
ইংরেজি শিখতে বইয়ের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যম, যেমন: বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ইউটিউবের সাহায্যও নিতে পারেন। তাই ভুলভ্রান্তি হলেও চর্চা শুরু করুন এবং ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বাড়ান। দেখতে পারেন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও অনর্গল কথা বলতে পারার জন্য কী করতে হবে? এই লেখাটি। এছাড়াও পড়ুন ইংরেজি শেখার সবচেয়ে সহজ উপায়!
এছাড়া চাকরির সাধারণ স্কিলগুলো তৈরি করতে হবে নিজেদের। এগুলোর মধ্যে আছে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের কাজ ভালো জানা, ভালো রিপোর্ট তৈরি করতে পারা, সঠিকভাবে ই-মেইল করতে পারা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন সফট স্কিলের চর্চা করুন।
কর্মক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সফট স্কিল সম্পর্কে জানতে পড়ুন- এই আটিকেলটি। যে ৭টি সফট স্কিল আপনার থাকতেই হবে।
আপনার জন্য কোন পেশা ভালো হবে তা জানতে ক্যারিয়ার ইনটেলিজেন্সের অনলাইন টেস্টে অংশ নিন।
তথ্যসূত্র:
১. ইত্তেফাক
২. প্রথম আলো
৩. উইকিপিডিয়া