মাহমুদুল হাসান
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। স্বায়ত্বশাসিত বা সরকারি অধিদপ্তরের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুযোগ ও অবদান দুটোই বেশি। বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আপনি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এছাড়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন গবেষণার কাজ করে থাকে। থিংকট্যাঙ্ক হিসেবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ, পাবলিক পলিসি ও দরিদ্রদের সহায়ক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে। গবেষণার পরিচিত ক্ষেত্রগুলো হলো সুশাসন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম, আন্ত:রাষ্ট্রীয় বিষয়সমূহ, কৃষি, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা, জীবনমান, জেন্ডার, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক কার্যক্রম ও সক্ষমতা নির্মাণ প্রভৃতি।
কাজের ধরন এবং যোগ্যতা
একজন গবেষককে সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমন : মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, রাজনৈতিক দল, আর্কাইভ) এবং বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এরপর রয়েছে তথ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও রিপোর্ট তৈরি করার কাজ। একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজ মাঠ পর্যায়ের রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট থেকে অনেক হাত ধরে চূড়ান্ত হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণ ও বুদ্ধিমত্তার সাথে উপস্থাপনের যোগ্যতা থাকতে হয়। অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে জিপিএ ৩.৫০ এর অধিকারীরাই কেবল আবেদন করতে পারে। প্রকাশিত গবেষণা সংকলন অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। পিএইচডি প্রার্থীরা অগ্রাধিকার লাভ করেন। রিসার্চ মেথোডোলজিতে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হয়। ইংরেজি ভাষা ও কম্পিউটারে দক্ষতা থাকাও জরুরি। এছাড়া একটি টিম হিসেবে কাজ করা এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার মানসিকতাসম্পন্ন হতে হয়। ভালো মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রার্থীর কোনো বিশেষ ট্রেনিংকে এবং কোনো প্রজেক্টে কাজের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা হয়।
গবেষক হিসেবে যোগদান ও ক্যারিয়ার
স্নাতকোত্তর সমাপ্তকারী ফ্রেশ প্রার্থীরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে রিসার্চ ইন্টার্নস, জুনিয়র রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট বা রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেতে পারেন। তবে আপনি যদি ছাত্র থাকাকালীনই প্রাথমিক গবেষণা কাজের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, তবে সরাসরি একজন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগদানেরও সুযোগ পেতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম ও চুক্তিভিত্তিতে কাজের সুযোগ দেয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এসব কাজ আগ্রহ নিয়ে করছেন। কারণ এসব জরিপধর্মী কাজে তারা যেমন কাজ শিখতে পারছেন, তেমনি কিছু টাকাও হাতে পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণার প্রাথমিক ট্রেনিংটাও হয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটভিত্তিক অনেক কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার প্রকল্পের কাজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে মাঠ পর্যায়ের কাজ করিয়ে নেয়। যে কোনো ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রীরই গবেষক হওয়ার সুযোগ আছে। সামাজিক গবেষণায় অর্থনীতি, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, জেন্ডার স্টাডিজ, কৃষি ও পরিসংখ্যান বিভাগের প্রার্থীরা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। তাছাড়া ব্যবসায় প্রশাসন, কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনোলজি, মানবিক, ফিজিক্যাল ও হেলথ সায়েন্স, চাইল্ড কেয়ার, ফুড, আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও গবেষণার সুযোগ আছে।
কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশের কয়েকটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নিচে দেয়া হলো। এছাড়া সাম্প্রতিক প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া বেতন-ভাতার পরিমাণও পাঠকদের সুবিধার্থে তুলে ধরা হলো:
* বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ। ১/৪৬, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা- ১০০০।
এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে এন্ট্রি লেভেলের গবেষণা কর্মকর্তার মাসিক বেতন ১১০০০-২০৭৪০/-। গবেষণা পরিচালকের বেতন ৬০০০০/-।
* সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত একটি সিভিল সোসাইটি থিঙ্কট্যাঙ্ক। এর একজন প্রোগ্রাম ম্যানেজারের প্রারম্ভিক বেতন মাসিক ৪৫০০০/-। এছাড়া সিনিয়র ডায়ালগ অ্যাসিস্ট্যান্টরা পান মাসিক ৩৫০০০/-।
* ব্র্যাক, ব্র্যাক সেন্টার (৫ম তলা), ৭৫ মহাখালী, ঢাকা-১২১২।
এর রিসার্চ অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশনের নিজস্ব উন্নয়ন কার্যক্রম ছাড়াও দেশ-বিদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবেষণা কাজ করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলোর মাসিক বেতন ৫০০০০-৫৫০০০/-, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটের ৩০০০০-৩৫০০০/- এবং স্টাফ রিসার্চারের ২৫০০০-৩০০০০/-।
* বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ। ই-১৭, আগারগাঁও, শেরে বাংলানগর, ঢাকা-১২০৭।
* উন্নয়ন অন্বেষন, ১৬/২, ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫।
জুনিয়র রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট -এর বেতন মাসিক ১২৭৩০-১৬২৫০ /-।
* বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (BILIA), হাউজ-২২, রোড-৭, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫।
পার্টটাইম রিসার্চ ইন্ট্রার্নের সম্ভাব্য মাসিক ভাতা ৬০০০/- প্রভৃতি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা
* প্লান বাংলাদেশ, হাউজ-১৪, রোড-৩৫, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২
* ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বাড়ী-১৪১, সড়ক-১২, ব্লক-ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩
* জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থার ঢাকাস্থ কার্যালয়। যেমন- ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন- IOM, হাউজ-১৩-এ, রোড- ১৩৬, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশীদারী প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে গবেষণার সুযোগ পাওয়া যায়।
দেশে ইসলামী কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। যেমন- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (BIIT), ইসলামী ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো প্রভৃতি।
এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে বিভিন্ন গবেষণা কাজ হয়ে থাকে। যেগুলো দেশের চলমান রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে কাজ করে। তবে এতে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ সীমিত। রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট এবং অভিজ্ঞরাই কাজ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যম ও দেশী-বিদেশী কোম্পানীতে গবেষণা বিভাগে গবেষণার সুযোগ তো আছেই।
শেষ কথা
এ সেক্টরে যারা ভালো করতে চান তাদের হতে হবে এককথায় Book warm। যারা গবেষক হওয়ার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন তাদের জন্য এ বিষয়টি বিবেচ্য। যেসব নবীনেরা গবেষণার কাজ করবেন তাদের গুরুসম গবেষকের সাহচর্য দরকার। প্রয়োজনে যিনি তার পক্ষে Referee হবেন।
এন্ট্রি লেভেলে বেশিরভাগ গবেষকের চাকরির নিরাপত্তা কম। যারা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উন্নতি ও সম্মানজনক অবস্থান সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে নিজ পারফরম্যান্সের উপর।
লেখককে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]