শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ মোকাবেলা করতে সহায়তার উপায়

আপনার শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ মোকাবেলা করতে সহায়তা করবেন যেভাবে

শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ মোকাবেলা করতে সহায়তা করার মূল চাবিকাঠি হলো তাদের মস্তিষ্কে কী ঘটছে তা বোঝা।

প্রিসিলা ভেইল, “স্মার্ট কিডস উইথ স্কুল প্রবলেমস” এর লেখিকা। তিনি বলেছেন- “শিক্ষার অন/অফ সুইচ হলো আবেগ”। আপনি ও আমি দুজনেই জানি এটি সত্য।

আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, যখন আমরা কোনো বিচ্ছেদের কারণে ভেঙে পড়ি তখন জ্যামিতির তত্ত্ব শিখা খুবই কঠিন। ২০০ বছর আগের কিছু নিয়ে ইতিহাসের পাঠ তেমন অর্থবহ হয় না যখন আমরা কোনো বন্ধুর সাথে তর্ক-বিতর্ক নিয়ে চিন্তিত থাকি… বা, আরও খারাপ কিছু।

আমাদের শিক্ষার্থীরা দিনের বেলা বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ বহন করে চলেছে। হয়তো কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তাদেরকে নিচে টেনে নিচ্ছে। হতে পারে তারা স্কুলে আজীবন ‘সংগ্রাম’ করে আসছে। অথবা, হতে পারে তারা কিছু কল্পনা করছে যা আসলে আরও খারাপ।

উদ্বেগ হলো আত্মরক্ষার একটি ফাংশন। এটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে। গুহামানব যুগে ফিরে যান; যখন বাঘ আশেপাশে লুকিয়ে থাকত, তখন উদ্বেগ একটি খুব সহায়ক ফাংশন ছিল। কিন্তু, আমাদের আধুনিক সমাজে এটি সাহায্যের চেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

এদিকে, আমরা উদ্বেগ থেকে মানুষকে বের করার জন্য খুবই ভালো চেষ্টা করি:

  • “চিন্তা কোরো না।”
  • “উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।”
  • “শান্ত হও।”

এই লাইনগুলি কতবার আসলে কাজ করে? শূন্য। একটিও নয়।

তবুও, আমরা এই কথা বলতেই থাকি। আমরা এটি করি কারণ আমরা অন্য কিছু জানি না। তবে, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ মোকাবেলা করতে সহায়তা করার আসল চাবিকাঠি হলো তাদের মস্তিষ্কে কী ঘটছে তা বোঝা।

মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে?

এখনই এই সাধারণ অ্যাকটিভিটিটি রতে চেষ্টা করুন: আপনার তর্জনী আঙুল ব্যবহার করে আপনার মেরুদণ্ডের কলামটি ট্রেস করুন। আপনার ঘাড়ের গোড়া থেকে শুরু করুন। এটি আপনার মাথার শুরু পর্যন্ত নিয়ে যান। এই পথেই সমস্ত তথ্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। সেখান থেকে, এটি মস্তিষ্কের তিনটি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যায়…

উদ্বেগের সদর রাস্তা…

অঞ্চল ১: মস্তিষ্কের আবেগ কেন্দ্র

আবেগ কেন্দ্র হলো মস্তিষ্কের প্রথম অংশ যা তথ্য গ্রহণ করে। এই অঞ্চলটি আবেগগুলি ট্রিগার এবং প্রক্রিয়া করে। মস্তিষ্কের আবেগ কেন্দ্রটি খুবই প্রাচীন। এর তিনটি মোড রয়েছে:

  1. রেড অ্যালার্ট! বিপদ!” মোড: আপনি কীভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন, তা বিবেচ্য নয়—একটি বাঘ আপনাকে অনুসরণ করছে বা আপনার বন্ধু ক্লাসে যাওয়ার পথে খারাপ কিছু  বলেছে… উভয় পরিস্থিতিই হুমকি। বাঘ আপনার শারীরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বন্ধুর মন্তব্য আপনার আবেগগত নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু, আবেগ কেন্দ্রের জন্য এটি কোনো ব্যাপার না। একটি হুমকি মানেই হুমকি। এবং সমস্ত হুমকিই “লাল সতর্কতা! বিপদ!” মোডকে ট্রিগার করে।

যখন “লাল সতর্কতা! বিপদ!” মোডে ট্রিগার করা হয়, মস্তিষ্ক… সতর্ক হয়ে যায়! এটি মস্তিষ্কের বাকি অংশ থেকে রাসায়নিক পদার্থসমূহ  টেনে নেয় যাতে আসন্ন বিপদের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এর মানে “রেড অ্যালার্ট!” মোডে মস্তিষ্কের বাকি অংশের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে যায়।

  1. গ্রিন জোন” মোড: যখন আপনি আনন্দ ও সম্পৃক্ততা অনুভব করেন, আবেগ কেন্দ্র সবুজ অঞ্চলে স্যুইচ করে। সবুজ অঞ্চলে, মস্তিষ্ক আসলে রাসায়নিক তৈরি করে, যা চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং যুক্তির জন্য মস্তিষ্কের বাকি অংশকে মূল্যবান শক্তি সরবরাহ করে।
  2. নিরপেক্ষ” মোড: এটি আমাদের ডিফল্ট মোড। এটি কিছুটা শিথিল, তবে সবসময় হুমকির জন্য সতর্ক থাকে। নিরপেক্ষ মোড মস্তিষ্কের রাসায়নিক প্রবাহকে “রেড অ্যালার্ট!” মোডের মতো সীমিত করে না। তবে, এটি মস্তিষ্কে রাসায়নিক তৈরি করে না, যেমনটা “সবুজ অঞ্চল” করে। নামের মতোই, এটি… নিরপেক্ষ।

অঞ্চল ২: মস্তিষ্কের সংগঠিত/স্ব-পরিচালনার কেন্দ্র

মস্তিষ্কের এই কেন্দ্রটি আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। যদি মস্তিষ্ক সবুজ অঞ্চল বা নিরপেক্ষ মোডে থাকে, সেক্ষেত্রে তথ্য আবেগ কেন্দ্র অতিক্রম করে, অঞ্চল ২-তে চলে যায়। এই বিভাগটি আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা করতে সহায়তা করে। এটি আমাদের স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট করতে সহায়তা করে। এটি আমাদের ক্লাসরুমে এবং বন্ধুদের সাথে বাইরে থাকার সময় আমাদের আচরণের পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। এটি আমাদের শান্ত হতে এবং যখন আমরা বিরক্ত হই তখন আমাদের অনুভূতিগুলি ম্যানেজ করতে সহায়তা করে।

অঞ্চল ৩: মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্র

মস্তিষ্কের এই অঞ্চলটি তথ্য প্রক্রিয়া করে, এটি দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতির জন্য সংরক্ষণ করে, এবং সমস্যার সমাধান করে। এই অঞ্চলটি আমাদের সর্বোচ্চ স্তরের চিন্তা ও প্রক্রিয়াকরণের কেন্দ্র।

উদ্বেগের মস্তিষ্কের জীববিজ্ঞান

দুশ্চিন্তা হলো উদ্বেগের প্রতি মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া। এটি মস্তিষ্কের আবেগ কেন্দ্রে “লাল সতর্কতা! বিপদ!” মোডকে ট্রিগার করে। এটি একটি দূষণ চক্র তৈরি করে, মস্তিষ্কের বাকি অংশ থেকে আরও বেশি রাসায়নিক টেনে নেয়।

উদ্বেগ যত বেশি বৃদ্ধি পায়, মস্তিষ্কের অন্য অঞ্চলগুলি তত বেশি বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণেই কাউকে “উদ্বেগ থেকে বেরিয়ে আসার” জন্য বললেও তা কাজ করে না। মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলি যুক্তিসঙ্গত সমস্যা সমাধান এবং আত্মব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেগুলি উদ্বেগের ঝড়ে আটকা পড়ে থাকে।

তাই, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ মোকাবেলা করতে কিভাবে সাহায্য করবেন যদি “কথায়” কাজ না করে?

উদ্বেগ মোকাবেলার তিনটি ধাপ-

১. তাদের শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন করুন: যখন মস্তিষ্কে উদ্বেগের চক্র চলছে, এটি মস্তিষ্কের বাকি অংশ থেকে রাসায়নিকগুলি টেনে নিচ্ছে। যুক্তি, ভাষা এবং ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার অংশগুলি বন্ধ হয়ে যায়। তাই, উদ্বেগ চক্র থামানোর একমাত্র উপায় হলো মস্তিষ্কের রাসায়নিক চক্রকে টেনে নিতে বাধা দেওয়া। সৌভাগ্যবশত, এটি করার একটি সহজ উপায় রয়েছে।

নড়াচড়া করুন! শারীরিক নড়াচড়া মস্তিষ্কের জন্য একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের মতো। যত বেশি অ্যারোবিক নড়াচড়া করবেন, মস্তিষ্ক তত বেশি রাসায়নিক তৈরি করে। যখন একজন শিক্ষার্থী উদ্বেগের চক্রে আটকা পড়ে, তাকে হাঁটতে বলুন বা ২০টি জাম্পিং জ্যাক করতে বলুন। অথবা দুটোই। উদ্বেগ যত বেশি, তত বেশি নড়াচড়া প্রয়োজন যাতে মস্তিষ্ক শান্ত হতে পারে।

রাসায়নিক পরিবর্তনের আরো দুটি উপায় রয়েছে, তবে এগুলির জন্য সময় ও ধৈর্য প্রয়োজন। প্রায়শই, একজন ব্যক্তি যখন উদ্বেগের মুখোমুখি হয়, তখন তার বেশি ধৈর্য থাকে না। তবুও, এগুলি কিছু পরিস্থিতিতে কার্যকর হতে পারে:

    • গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস: হৃদস্পন্দন ধীর করা উদ্বেগ চক্রকে ধীর করে।
    • ইমোশনাল ফ্রিডম টেকনিক (ইএফটি): ইএফটি নির্দিষ্ট মেরিডিয়ান পয়েন্টে ট্যাপ করার মাধ্যমে নেতিবাচক আবেগ মুক্ত করে। (অনলাইনে এ সংক্রান্ত প্রচুর ভিডিও পাবেন)। একটি সহজ ইএফটি কৌশল হলো- শিক্ষার্থীদের তাদের তর্জনি ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে সংযোগ স্থানটি ৩০ সেকেন্ডের জন্য ম্যাসাজ করতে বলা। তারপর, হাত পরিবর্তন করে আবার ম্যাসাজ করতে বলুন।

অনুভূতির চাকা

২. কী ঘটছে তা নির্ধারণ করুন: একবার উদ্বেগ কমে গেলে, শিক্ষার্থীকে কী জিনিস তাকে বিপর্যস্ত করছে এবং কেন- তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করুন। (এই আলোচনা শিক্ষার্থীর হাঁটাচলা করার সময়েই শুরু করা দরকার, যাতে উদ্বেগ আবার ট্রিগার না হয়।) একটি অনুভূতি চক্র (Feeling Wheel) ব্যবহার করে তাদের নির্দিষ্ট অনুভূতিগুলির নামকরণ করতে সাহায্য করুন। অনুভূতির নামকরণ ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত কেন করতে হবে তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে:

    • এই পদ্ধতিতে সমস্যাটিকে মস্তিষ্কের আবেগ কেন্দ্র থেকে মস্তিষ্কের উচ্চ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রতে স্থানান্তরিত হয়।
    • অনুভূতিগুলির নামকরণ এবং সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারলে তাকে ম্যানেজ করা আরও সহজ হয়।
    • অনুভূতির নামকরণ শিক্ষার্থীকে সেই অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ দেয় এবং এটির ব্যাপারে ভয় কমিয়ে দেয়।
    • শিক্ষার্থীরা সমস্যাটি স্পষ্টভাবে সনাক্ত করার জন্য সময় নেওয়ার ফলে আরো বেশি সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হয়।
    • তাদেরকে কোন বিষয়টি উদ্বিগ্ন করছে তা আরও ভালভাবে বুঝতে পারলে, একজন শিক্ষক হিসাবে আপনি তাদেরকে আরও ভালোভাবে  সমাধানের পথ দেখাতে সক্ষম হবেন।

৩. শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা গড়ে তুলুন: এই নিবন্ধের তথ্য শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্বেগ মোকাবেলা করার দক্ষতা গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। তাদের বুঝতে সাহায্য করুন উদ্বেগের সময় কী ঘটছে। তাদের বুঝতে সাহায্য করুন কী কাজ করবে এবং কী কাজ করবে না।

প্রয়োজনের আগেই বিষয়টি শিক্ষার্থীদেরকে শেখান যাতে এটি দরকারে তারা ব্যবহার করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের যে পরিস্থিতি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে তাকে ম্যানেজ করার দক্ষতা তৈরি করতে সাহায্য করুন। প্রায়ই, স্কুলে শেখা বা প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের উপর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা যখন এই চ্যালেঞ্জগুলি নেভিগেট করার জন্য কৌশলগুলি আত্মস্থ করে, তখন পরিস্থিতিগুলি আর উদ্বেগ সৃষ্টি করে না।

উপসংহার

উদ্বেগ মারাত্মকভাবে মস্তিষ্কের যৌক্তিক সমস্যা সমাধানের উচ্চতর অঞ্চলকে সীমাবদ্ধ করে বা কখনো পুরোপুরি বন্ধ করে। তাই, কাউকে উদ্বেগ থেকে বেরিয়ে আসতে বলা বা তাদের কাছে যৌক্তিক চিন্তভাবনা করার আশা করবেন না। যদি শিক্ষার্থীরা কখনো আপনার ক্লাসে প্রতিক্রিয়া না দেয়, তার মানে এই নয় যে, তারা তখন কঠিন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বরং তাদের মস্তিষ্কের জীববিজ্ঞান তাদের যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করা অসম্ভব করে তোলে।

উদ্বেগের সময় শিক্ষার্থীকে সহায়তা করার জন্য, তাদের মুভ করতে দিন! অ্যারোবিক কার্যকলাপ হলো উদ্বেগের দূষণ চক্রকে ভাঙার সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর উপায়।

এরপর, সমস্যাটি নিয়ে তাদেরকে কথা বলতে বলুন। তাদের সমস্যাটি বর্ণনা করতে বলুন। কেন এটি তাদের বিরক্ত বা উদ্বিগ্ন করছে এবং তারা এটি নিয়ে কেমন অনুভব করছে তা অনুভূতি চক্র ব্যবহার করে বের করতে বলুন।

এই প্রক্রিয়াটি অনেক  উপকার করে। এটি সমস্যাটিকে মস্তিষ্কের উচ্চতর অঞ্চলে নিয়ে আসে, হুমকির অনুভূতিকে হ্রাস করে। শিক্ষার্থীদেরকে পরিস্থিতির ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ দেয় এবং সম্ভাব্য সমাধান ভালোভাবে সনাক্ত করতে সহায়তা করে।

পরিশেষে, তাদের দক্ষতা তৈরি করুন। তারা যেন উদ্বেগ মোকাবেলা এবং যে পরিস্থিতি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে সেই পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারে।

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top