বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং নিয়ে কেন বিতর্ক

আমানুর রহমান : দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার মান প্রশ্নের মুখে রয়েছে। এরই মধ্যে গত ১০ নভেম্বর ওআরজি কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে। র‌্যাংকিং করার কাজে অর্থায়ন করেছে একটি অন-লাইন পত্রিকা ও ইংরেজি দৈনিক। এ র‌্যাংকিং নিয়ে প্রথম দিন থেকেই বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে। এ সমালোচনা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয়, যাদের নিয়ে গবেষণা তারাও এ বিতর্ক ও সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২-১ দিনের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশও (এপিইউবি) এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেছে ১৯৯২ সাল থেকে। বর্তমানে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৫টি। বর্তমান সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১০-১২ এখনো শিক্ষাকার্যক্রম শুরুই করেনি। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে র‌্যাংকিং করা হলো। এ র‌্যাংকিং প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে এ বিতর্কের ভালো একটি দিক হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যারাই আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কেউই একে প্রত্যাখ্যান করেননি। সবাই বলেছেন, এ র‌্যাংকিং করার ক্ষেত্রে আরো সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেয়া যেত।

ছাত্র-শিক অনুপাত, গবেষণা প্রকল্প ও অভ্যন্তরীণ কয়েকটি তথ্যের ওপর ভর করে দু’টি গণমাধ্যমের করা সাম্প্রতিক এ র‌্যাংকিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। ভর্তি মওসুমের আগ মুহূর্তে প্রকাশিত এ ধরনের র‌্যাংকিংকে ‘দুরভিসন্ধি’ হিসেবে দেখছেন তাদের কেউ কেউ। দেশের শীর্ষ বেসরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সংবাদ সম্মেলন করে এ ধরনের র‌্যাংকিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

তারা এর গবেষণাপদ্ধতি, র‌্যাংকিংয়ের মানদণ্ড বা বিবেচ্য বিষয় ও তথ্য-উপাত্তকে সঠিক ও তথ্যনির্ভর নয় বলে আখ্যায়িত করেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো ও ব্যাক ডেটেড তথ্যের ভিত্তিতে করা র‌্যাংকিংকে এক ধরনের উপহাস বলে অভিহিত করেছে। তবে প্রথমবারের মতো হলেও এক ধরনের র‌্যাংকিংয়ের উদ্যোগকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এ র‌্যাংকিং প্রত্যাখ্যানের কিছু নেই। র‌্যাংকিংয়ের পদ্ধতি ও গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তথ্যগুলো ব্যাক ডেটেডে। এখানেই আমাদের প্রতিবাদ।

গত ১০ নভেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং দ্বিতীয় অবস্থানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি)।

গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিভিন্ন অসঙ্গতির তালিকায় থাকা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিয়ে মোট ৩২টি প্রতিষ্ঠানের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এর মধ্য থেকেই ফ্যাকচুয়াল বা বাস্তবতাভিত্তিক তথ্য এবং পারসেপচুয়াল বা ধারণাভিত্তিক স্কোরের সমন্বয়ে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ফ্যাকচুয়াল তথ্যের মধ্যে শিার্থী সংখ্যা, শিক, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা ও গবেষণায় খরচের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১৪ সালের রিপোর্ট থেকে নেয়া। অন্য দিকে পারসেপচুয়াল তথ্যের মধ্যে রয়েছে শিার পরিবেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিকদের মান, চাকরিেেত্র পাস করা শিার্থীদের কর্মদতা, নেতৃত্ব দেয়ার মতা, যোগাযোগ দতা ইত্যাদি। যার স্কোরগুলো নেয়া হয়েছে অ্যাকাডেমিক (ডিন, বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার) ও চাকরিদাতাদের কাছ থেকে।

এ দিকে র‌্যাংকিং তালিকা প্রকাশের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠে বিতর্কের ঝড়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার অন্যতম বড় নিয়ামক স্থায়ী ক্যাম্পাস। অথচ তা র‌্যাংকিংয়ের বিবেচনায় আনা হয়নি। এতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই পিছিয়ে পড়েছে। দেশে বর্তমানে ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্যক্রম থাকলেও মাত্র ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ র‌্যাংকিং করা হয়েছে।

এ র‌্যাংকিং নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম আরো বলেছেন, ২০১৪ সালের তথ্য দিয়ে ২০১৭ সালের র‌্যাংকিং কতটা গ্রহণযোগ্য? এটিকে আমাদের কাছে বেখাপ্পা মনে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, র‌্যাংকিং পদ্ধতি, বিবেচ্য বিষয়াদি, গাণিতিক ফলাফলসহ তথ্য-উপাত্ত সবই অস্পষ্ট ও কোনো কোনো েেত্র ত্রুটিপূর্ণ। বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিরপেতা ও বিচারিক গুণ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

দশম স্থানে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ বলে, সঠিক পদ্ধতি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে করলে ড্যাফোডিল আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আসত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, গবেষণায় পারসেপচুয়াল এবং ফ্যাকচুয়াল র‌্যাংকিংয়ের সমন্বয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অবস্থান দশম স্থানে দেখানো হয়েছে, যা বাস্তবতাবিবর্জিত। তিনি বলেন, এ ধরনের গবেষণা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। এ গবেষণায় অনেক কিছুই আসেনি বলে দাবি করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত দুই দশক ধরে কাজ করছে। শিক্ষিত জাতি গড়ার জন্য কাজ করলেও তাদের ভেতরে সূক্ষ্মভাবে ব্যবসায়িক চিন্তা রয়েছে। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন সংস্থা সুবিধা নিয়ে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভর্তি মওসুম স্প্রিং সেমিস্টারের প্রাক্কালে এ ধরনের জরিপ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা।

তাদের কেউ কেউ বলেন, যে প্রতিষ্ঠানটির অর্থায়নে এ র‌্যাংকিং করা হলো, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের বা মাদার অর্গানাইজেশনেরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষ স্থানে তুলে ধরা হয়েছে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রধান শর্ত হচ্ছে স্থায়ী বা নিজস্ব ক্যাম্পাসে উচ্চশিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা। যারা দেশের আইন মানেন না তাদের শীর্ষস্থানে তুলে আনার মাধ্যমে পুরো র‌্যাংকিং কার্যক্রমকেই বিতর্কের মুখে ফেলেছে।

সূত্র : নয়া দিগন্ত

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top