স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্ট

female-pharmacist

মো: আরিফুর রহমান ফাহিম

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদেরকে দিন দিন আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিত্য নতুন চিকিৎসার অগ্রগতি আমাদের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে বহুলাংশে। আর এসব পরিবর্তনের পিছনে কাজ করছেন বেশ কিছু মেধাবী তরুণ তরুণী। তাদের সেবা, পাশাপাশি ড্রাগ বা ওষুধের নিত্য নতুন উদ্ভাবন চিকিৎসা সেবাকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। আর এই সেবাদানকারীরা হলেন ফার্মাসিস্ট। একজন ফার্মাসিস্ট নতুন ওষুধ আবিষ্কার থেকে শুরু করে রোগী কর্তৃক ব্যবহার ইত্যাদি যেকোনো প্রকার কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেন।

ফার্মাসিস্টদের কাজ কী, তারা কারা, তারা কী করেন -এসব বিষয়ে আমাদের অনেক শিক্ষিত মানুষেরও পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেকেই মনে করেন ওষুধের দোকানে যিনি বিক্রেতা তিনিই ফার্মাসিস্ট। অথচ উন্নত দেশে হসপিটাল ও কমিউনিটি ফার্মাসিস্টদের ফার্মাসিস্ট হিসেবে চাকরি রয়েছে। ওষুধ শিল্প বিকশিত হচ্ছে বলে আমরা যদি শুধু ছেলে-মেয়েদের ফার্মেসিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে ওষুধ প্রস্তুতি ও বিপণনে অংশগ্রহণকে বুঝিয়ে থাকি তবে তা হবে হতাশাজনক।

ওষুধ শিল্পের বিকাশ হচ্ছে তখন বলা যাবে, যখন আমরা এপিআই ম্যানুফ্যাকচার করবো, কমিউনিটি বেইজড স্বাস্থ্য সেবায় ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। সত্যিকারের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট একটিভিটিজ হবে।

অনেকেরই ধারণা, ফার্মাসি পড়লে শুধু ওষুধশিল্পে কাজ করতে হয়। এর বাইরেও তাঁদের জন্য কাজের নানা ক্ষেত্র রয়েছে। ফার্মাসিস্টদের কাজ শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোতে নয়, ওটা তাঁদের কয়েকটি কাজের জায়গার মাত্র একটি। এর বাইরে তাঁদের সরকারি নানা দফতর, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, কমিউনিটি ফার্মাসি, শিক্ষকতা, গবেষণাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিয়োগ লাভের সুযোগ আছে।

ফার্মাসিস্ট বা ওষুধ বিশেষজ্ঞ হলেন এমন এক ব্যক্তি  যিনি ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং বিধিবদ্ধ সংস্থা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে ফার্মেসি পেশা চর্চার জন্য নিবন্ধন পেয়েছেন। দেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্সদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্ট থাকার কথা থাকলেও স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও আমরা এ সংস্কৃতিটা চালু করতে পারিনি।
উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে সম্পাদন করেন ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্স। তাই স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এদেশের ফার্মেসি সেবার মান বাড়ানো অতীব জরুরি। তা না হলে স্বাস্থ্যসেবা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে না।

এ দেশের হাসপাতালগুলোতে ফার্মেসি সেবা বলতে বোঝায়, বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা এবং ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীর কাছে হস্তান্তর করা। এটা খুবই আনন্দদায়ক ও আশার বিষয় যে এদেশের বেসরকারি হাসপাতাল, যেমন স্কয়ার, ইউনাইটেড, অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই উন্নত মানের ফার্মেসি সেবা দানের জন্য ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করছে।

১৬ মার্চ, ২০১২ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের ওষুধ খাতের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারের প্রধান অতিথির বক্তব্যে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ওষুধ শিল্পে আমরা ভালোই এগিয়ে গেছি। তবে নিয়োগ ও পদায়ন নিয়ে ডাক্তাদের মধ্যে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। তাদের দিয়ে কাজ করানো যায় না। তিনি বলেন, তাজমহলের নাম উঠলে মমতাজ ও শাহজাহানের নাম শুনি। তবে এর নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের নাম ওঠে না। ইউরোপ ও আমেরিকায় গেলে যে কোনো ওষুধ কিনতে পারি, তেমনি তা আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। আমাদের ওষুধ শিল্প যাদের জন্য বিকশিত হচ্ছে, তাদের (ফার্মাসিস্টদের) নাম শোনা যায় না। তাই রাজনীতির জন্য নয়, জাতীয় কারণেই ফার্মাসিস্টদের দাবি মানা উচিত। মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার আগে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখানে বাজার করেছে। এতে আমাদের দেশে ওষুধের মৌলিক কোনো বাজার হয়নি। ফার্মাসিস্টদের দাবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ফার্মাসিস্টদের দাবি-দাওয়া জাতিকে জানাতে হবে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্যই তাদের দাবি-দাওয়া প্রচারিত হওয়া দরকার।

১৯৯৭ সালে একবার পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে দেশের বড় ৬টি হাসপাতালে ’হসপিটাল ফার্মেসি’ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালের মধ্যে দ্বৈত প্রশাসন সৃষ্টি হবার ধুয়া তুলে তৎকালীন কারো কারো বিরোধিতায় সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মত ’হসপিটাল ফার্মেসী’ চালুর উদ্যোগ সফল হলে সার্বিক ওষুধ শিল্প এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্টরা চিকিৎসার জন্য ওষুধ ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান, ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজরদারি ও প্রতিরোধকরণে বিশেষ পারদর্শী। সর্বোপরি রোগীর চাহিদা অনুযায়ী ফার্মেসি সেবা প্রদান করতে হলে ফার্মাসিস্টের কোনো বিকল্প নেই।
পত্রিকায় খবরে প্রকাশ, নিম্ন ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধ এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ওষুধনীতির চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রণয়ন করা এ নীতিমালা অনুযায়ী একটি মূল্য-নির্ধারণী কমিটির মাধ্যমে সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে গঠন করা হবে ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে হবে ‘কমিউনিটি ফার্মেসি’। আদায়কৃত রাজস্বের ১৫ শতাংশের অংশীদার হবেন এ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। এ ছাড়া সব বিভাগীয় শহরে ওষুধ পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। তাপ সংবেদনশীল ওষুধের কার্যকারিতা ও গুণগত মান বজায় রাখতে ওষুধের দোকানে রেফ্রিজারেটর রাখা এবং এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের যথাযথ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে সব পাইকারি ও খুচরা দোকান এবং কোম্পানির সংরক্ষণাগার বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।

এটা সর্বজনস্বীকৃত যে ভালো ফার্মাসিস্ট ছাড়া সঠিক গুণগত মানের ওষুধ উৎপাদন অসম্ভব। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ফার্মেসি বিভাগ খোলা হলেও বর্তমানে দেশের অনেকগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়ানো হচ্ছে। এই বিভাগগুলো দেশের ওষুধ শিল্পকে নিয়মিতভাবে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ করছে। শীর্ষস্থানীয় এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি) দেশ হবার পরেও আমাদের দেশের কমপক্ষে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ রয়েছে এবং বছরে কমপক্ষে দুই হাজার ফার্মাসিস্ট তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশই যেখানে ফার্মাসিস্টদের অভাবে তাদের ওষুধ শিল্পকে বিকশিত করতে পারছে না সেখানে দক্ষ জনশক্তি ও বিদেশ থেকে এদেশে প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাই ওষুধের গুণগতমান ও সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের পাশাপাশি সব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

email: [email protected]

ক্যারিয়ার, ট্রেনিং ও স্কলারশিপ সম্পর্কে
exclusive তথ্য পেতে ফেসবুক গ্রুপে
জয়েন করুন-

Career Intelligence | My Career Partner

Scroll to Top